মহান ভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সাল থেকে ‘ঠিকানা’ পত্রিকার পথচলা শুরু। নিউইয়র্ক পৌর এলাকার বাংলা ভাষা-ভাষীদের দিশারি ও যোগসূত্র স্থাপনকারী এই পত্রিকা আমাদের সকলেরই হৃদয়ে স্থান নিয়ে আছে বিগত ৩৪টি বছর ধরে। আমার সঙ্গে এই পত্রিকার যোগসূত্র সে বছর থেকেই। ওই বছরের ২৯ জুলাই আমার মা ও আমরা ৭ ভাই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজযোগে নিউইয়র্কে আসি অভিবাসী হিসেবে। আমার বাবা আমাদের আগেই আসেন ১৯৮৭ সালের মে মাসে। তবে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা হয় নিউজার্সিতে। সে সময় এখানে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। নিউইয়র্কে কুইন্সের জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড স্ট্রিট এবং নিউজার্সির প্যাটারসনে ও জার্সি সিটিতে কিছু বাঙালির দেখা পাওয়া যেত সপ্তাহান্তে। সে সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। মহান স্রষ্টাকে ধন্যবাদ তার জন্য।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষ যে দেশেই যাক না কেন, তার খাদ্যতালিকায় মাছ থাকবেই এবং কোনো উৎসব থাকলে সেদিন যদি ইলিশ মাছ না হয়, তাহলে সে ভোজন উৎসবটা যেন কিছুটা হলেও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সে জন্যই আমার বাবা, আমি ও দু-এক ভাই মাঝে মাঝে কুইন্সের গ্রোসারি দোকানগুলোতে যেতাম দেশি মাছ, মসলা ও শাকসবজির জন্য। সেগুলোর সঙ্গে অন্য যে জিনিসটা সব সময়ই আনতে হতো, সেটা ছিল প্রিয় পত্রিকা ‘ঠিকানা’। সে সময়টাতে দেশের বিভিন্ন বড়-ছোট সংবাদগুচ্ছ, কমিউনিটির রকমারি খবরাদি, প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপনের সমারোহ এবং কিছু গল্প-কবিতা পাওয়ার মাধ্যম ছিল ঠিকানা। প্রবাসে থেকে প্রধান ভাষা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার মাঝে বাংলার মতো সুমিষ্ট ভাষায় ওইসব কিছু এক জায়গায় পাওয়া ছিল পরম পাওয়া। আমার মা এবং আমরা কয়েক ভাই পত্রিকাটা এ-পাতা থেকে ও-পাতা ভাগাভাগি করে পড়তাম। বাবা না পড়লেও জানতে চাইতেন আমরা কী পড়েছিলাম। ঠিকানার সঙ্গে পঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় যোগ দিত ঢাকা থেকে ডাকযোগে আসা ক্যাথলিক সাপ্তাহিক ‘প্রতিবেশী’, ম্যানহাটনের এক ছোট্ট বাংলা বইয়ের দোকান থেকে মাঝেমধ্যে কেনা ঢাকার ‘বিচিত্রা’ এবং কলকাতার ‘দেশ’ ও ‘সানন্দা’। তবে স্থানীয় খবরাদি সরবরাহে, কমিউনিটির মাঝে যোগাযোগ স্থাপনে এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সেবা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ দিতে ‘ঠিকানা’র তুলনা ছিল না। এ জন্য ঠিকানার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকবে সব সময়।
আরেকটা কারণে ‘ঠিকানা’ আমার হৃদয়জুড়ে থাকবে, যত দিন তা মঙ্গলময় স্রষ্টা সজীব-সচল রাখেন। নিউজার্সিতে অবস্থিত সিটন হল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে গেলাম, তখন কয়েক দিনের ভেতর আবিষ্কার করলাম, এত বড় ক্যাম্পাসে আমিই একমাত্র বাঙালি। কখনো কখনো পুরো সপ্তাহ চলে যেত কোনো বাংলা শুনতে বা বলতে পারতাম না। বাংলাহীন অবস্থায় মাঝে মাঝে মনে হতো আমি হয়তো-বা শিকড়হীন, ঠিকানাবিহীন একজন কেউ হয়ে যাচ্ছি। তখন মুঠো/সেলফোন তেমন ছিল না, ইন্টারনেটের ব্যবহারও তেমন ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। তবে ই-মেইল ব্যবহার সবেমাত্র জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। ছাত্রাবাসে ছাত্রদের ঘরে ফোন ছিল না, হলের শেষ মাথায় একটা পাবলিক ফোন ছিল, যাতে পয়সা দিয়ে ফোন করা যেত। সপ্তাহান্তে আমি বাসায় ফোন দিতাম মা, বাবা, ছোট ভাইদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। শুধু সেই সময় বাংলায় কথা বলতে পারতাম এবং পরিবার ও কমিউনিটির খবরাদি পেতাম। একদিন আমার সংগ্রহে রাখা কিছু ম্যাগাজিনের ভেতর প্রিয় ‘ঠিকানা’র পুরোনো একটা সংখ্যা পেলাম। সব খবর পুরোনো হয়ে গেলেও আনমনে পত্রিকাটার পাতাগুলো উল্টাতে ভালোই লাগছিল। হঠাৎ করেই ডাকযোগে গ্রাহক হওয়ার একটা গ্রাফিক্স চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই অংশটা কেটে নাম, ঠিকানা ইত্যাদি পূরণ করলাম। পরে ডাকঘরে গিয়ে বার্ষিক গ্রাহক চাঁদার পরিমাণে মানি অর্ডার কিনে, আমার তখন ব্যাংকের চেকিং অ্যাকাউন্ট ছিল না বিধায়, একসঙ্গে ‘ঠিকানা’র অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। ক্লাস শেষে মেইল রুমে গেলাম আমার চিঠি আনতে, আর বক্স খুলতেই আমার দু-তিনটা চিঠির মাঝে পেলাম প্রথমবার গ্রাহক হিসেবে প্রিয় ‘ঠিকানা’। খবর, সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, মন্তব্য, গল্প, কবিতাগুচ্ছ এমনকি বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে বাংলাহীন থেকে হয়ে গেলাম বাংলাময়। যারা প্রবাসে একা কখনো থেকেছেন, অন্য কোনো বাংলাভাষী ছাড়া, তারাই বুঝতে পারবেন এই বাংলাহীনতার কষ্ট ও বাংলাময়তার আনন্দ। প্রিয় ‘ঠিকানা’ আমাকে সেই আনন্দময়তাই দিয়েছিল নব্বইয়ের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে।
এই আনন্দঘন ৩৫তম বর্ষে পদার্পণের উৎসবে সম্মানীয় এম এম শাহীন, শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ ফজলুর রহমান, জাভেদ খসরু, মুহম্মদ শামসুল হক, শহীদুল ইসলাম, অধ্যাপিকা হুসনে আরা বেগমসহ ‘ঠিকানা’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে এবং শুভানুধ্যায়ীদের অভিনন্দন, আনন্দবার্তা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মঙ্গলময় স্রষ্টার কাছে এই পত্রিকার উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং সকলের মঙ্গল কামনা করি।
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষ যে দেশেই যাক না কেন, তার খাদ্যতালিকায় মাছ থাকবেই এবং কোনো উৎসব থাকলে সেদিন যদি ইলিশ মাছ না হয়, তাহলে সে ভোজন উৎসবটা যেন কিছুটা হলেও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সে জন্যই আমার বাবা, আমি ও দু-এক ভাই মাঝে মাঝে কুইন্সের গ্রোসারি দোকানগুলোতে যেতাম দেশি মাছ, মসলা ও শাকসবজির জন্য। সেগুলোর সঙ্গে অন্য যে জিনিসটা সব সময়ই আনতে হতো, সেটা ছিল প্রিয় পত্রিকা ‘ঠিকানা’। সে সময়টাতে দেশের বিভিন্ন বড়-ছোট সংবাদগুচ্ছ, কমিউনিটির রকমারি খবরাদি, প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপনের সমারোহ এবং কিছু গল্প-কবিতা পাওয়ার মাধ্যম ছিল ঠিকানা। প্রবাসে থেকে প্রধান ভাষা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার মাঝে বাংলার মতো সুমিষ্ট ভাষায় ওইসব কিছু এক জায়গায় পাওয়া ছিল পরম পাওয়া। আমার মা এবং আমরা কয়েক ভাই পত্রিকাটা এ-পাতা থেকে ও-পাতা ভাগাভাগি করে পড়তাম। বাবা না পড়লেও জানতে চাইতেন আমরা কী পড়েছিলাম। ঠিকানার সঙ্গে পঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় যোগ দিত ঢাকা থেকে ডাকযোগে আসা ক্যাথলিক সাপ্তাহিক ‘প্রতিবেশী’, ম্যানহাটনের এক ছোট্ট বাংলা বইয়ের দোকান থেকে মাঝেমধ্যে কেনা ঢাকার ‘বিচিত্রা’ এবং কলকাতার ‘দেশ’ ও ‘সানন্দা’। তবে স্থানীয় খবরাদি সরবরাহে, কমিউনিটির মাঝে যোগাযোগ স্থাপনে এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সেবা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ দিতে ‘ঠিকানা’র তুলনা ছিল না। এ জন্য ঠিকানার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকবে সব সময়।
আরেকটা কারণে ‘ঠিকানা’ আমার হৃদয়জুড়ে থাকবে, যত দিন তা মঙ্গলময় স্রষ্টা সজীব-সচল রাখেন। নিউজার্সিতে অবস্থিত সিটন হল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে গেলাম, তখন কয়েক দিনের ভেতর আবিষ্কার করলাম, এত বড় ক্যাম্পাসে আমিই একমাত্র বাঙালি। কখনো কখনো পুরো সপ্তাহ চলে যেত কোনো বাংলা শুনতে বা বলতে পারতাম না। বাংলাহীন অবস্থায় মাঝে মাঝে মনে হতো আমি হয়তো-বা শিকড়হীন, ঠিকানাবিহীন একজন কেউ হয়ে যাচ্ছি। তখন মুঠো/সেলফোন তেমন ছিল না, ইন্টারনেটের ব্যবহারও তেমন ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। তবে ই-মেইল ব্যবহার সবেমাত্র জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। ছাত্রাবাসে ছাত্রদের ঘরে ফোন ছিল না, হলের শেষ মাথায় একটা পাবলিক ফোন ছিল, যাতে পয়সা দিয়ে ফোন করা যেত। সপ্তাহান্তে আমি বাসায় ফোন দিতাম মা, বাবা, ছোট ভাইদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। শুধু সেই সময় বাংলায় কথা বলতে পারতাম এবং পরিবার ও কমিউনিটির খবরাদি পেতাম। একদিন আমার সংগ্রহে রাখা কিছু ম্যাগাজিনের ভেতর প্রিয় ‘ঠিকানা’র পুরোনো একটা সংখ্যা পেলাম। সব খবর পুরোনো হয়ে গেলেও আনমনে পত্রিকাটার পাতাগুলো উল্টাতে ভালোই লাগছিল। হঠাৎ করেই ডাকযোগে গ্রাহক হওয়ার একটা গ্রাফিক্স চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই অংশটা কেটে নাম, ঠিকানা ইত্যাদি পূরণ করলাম। পরে ডাকঘরে গিয়ে বার্ষিক গ্রাহক চাঁদার পরিমাণে মানি অর্ডার কিনে, আমার তখন ব্যাংকের চেকিং অ্যাকাউন্ট ছিল না বিধায়, একসঙ্গে ‘ঠিকানা’র অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। ক্লাস শেষে মেইল রুমে গেলাম আমার চিঠি আনতে, আর বক্স খুলতেই আমার দু-তিনটা চিঠির মাঝে পেলাম প্রথমবার গ্রাহক হিসেবে প্রিয় ‘ঠিকানা’। খবর, সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, মন্তব্য, গল্প, কবিতাগুচ্ছ এমনকি বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে বাংলাহীন থেকে হয়ে গেলাম বাংলাময়। যারা প্রবাসে একা কখনো থেকেছেন, অন্য কোনো বাংলাভাষী ছাড়া, তারাই বুঝতে পারবেন এই বাংলাহীনতার কষ্ট ও বাংলাময়তার আনন্দ। প্রিয় ‘ঠিকানা’ আমাকে সেই আনন্দময়তাই দিয়েছিল নব্বইয়ের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে।
এই আনন্দঘন ৩৫তম বর্ষে পদার্পণের উৎসবে সম্মানীয় এম এম শাহীন, শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ ফজলুর রহমান, জাভেদ খসরু, মুহম্মদ শামসুল হক, শহীদুল ইসলাম, অধ্যাপিকা হুসনে আরা বেগমসহ ‘ঠিকানা’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে এবং শুভানুধ্যায়ীদের অভিনন্দন, আনন্দবার্তা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মঙ্গলময় স্রষ্টার কাছে এই পত্রিকার উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং সকলের মঙ্গল কামনা করি।
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।