রাষ্ট্রীয় বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদেই জন্ম নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এটা অবশ্যই রাজনৈতিক অধিকারবোধ ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আকাক্সক্ষা থেকে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক পরিচয়বিহীন একটি সংঘশক্তি। তারপর ঘটনাপ্রবাহের নানা আবর্তন ও বিবর্তনে তা রূপলাভ করেছে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আর এ আন্দোলনে প্রাণশক্তি জুগিয়েছিল প্রথমে ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্রীয় নীতির আকাক্সক্ষা ও পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ‘স্বৈরাচার’কে চিরতরে বিদায়ের বাসনা। সেটা মাথায় রেখেই কিন্তু আমাদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি ও সম্ভাবনাকে ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগাতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই চিন্তাভাবনা না করে, গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে রাজনৈতিক অপশক্তি থেকে মুক্তি পেতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক দলে রূপ দেওয়ার কথা বলছেন। এ প্রেক্ষাপটে বিষয়টা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। কথায় আছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের এর ভালো ও মন্দ দিকগুলো ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা করেই এগোনো উচিত। রাজনীতির নামে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী বা দলের স্বার্থ চরিতার্থ করার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন ধারার নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে নবপ্রজন্মকে রাজনীতিতে আগ্রহী ও নেতৃত্বের সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তাই বলে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের নির্দলীয় আন্দোলনকে রাজনৈতিক দলে রূপ দেওয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
অন্য নামে অন্য প্ল্যাটফর্মে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেওয়াতে কোনো দোষ নেই। বরং সেটা হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং এ ধরনের উদ্যোগকে দেশের আপামর জনসাধারণ স্বাগত জানাবে। কিন্তু সেই নতুন রাজনৈতিক দলকে কোনো অবস্থাতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্যে কাজ করবে। সেটাই হবে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মনে রাখতে হবে, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ই আমাদের বৈষম্যহীন রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের মূলমন্ত্র। শিক্ষার্থীদের ইচ্ছে অনুযায়ী রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শ গ্রহণের সেই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার মাধ্যমে জাতীয় দুর্দিনে জাতীয় স্বার্থে যে ঐক্য তারা গড়ে তুলেছে, একটি একক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে টেনে আনার প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের সে ঐক্যকে বিনষ্ট করা জাতির জন্য একটা দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। ফলে ঐক্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গঠনমূলক পরিবর্তনের একটি দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে একটি ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অপরাজনীতির দুষ্টচক্র হতে দেশ ও জাতিকে মুক্তি দিতে বিকল্প ধারার নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সেটা একটি অনন্য সংঘশক্তি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর বুক চিরে কিংবা বুকের ওপর দাঁড়িয়ে কেন হতে হবে? বিষয়টা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে বলব। দূষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সেবাদাস গণমাধ্যম (তথ্যপ্রবাহ) ব্যবস্থার বিপরীতে এই সংঘশক্তিকে একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং জাতীয় পর্যায়ের একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো উচিত। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে এ প্রতিষ্ঠান অনন্য ভূমিকা রাখবে। যেখানে বৈষম্য (অন্যায় ও অবিচার) কিংবা স্বৈরাচারী আচরণ (নিগৃহ ও নির্যাতন) পরিলক্ষিত হবে, সেখানেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যাবে শিক্ষার্থীরা এবং নিরন্তর লড়ে যাবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়। কেবল তখনই অধঃপতিত এ সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করা, আলোর পথে ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা যেসব গঠনমূলক কাজ করেছেন এবং করছেন, সেগুলো কিন্তু তাদের মূল কাজ নয়। এসব তাদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ এবং কোনো কোনোটাকে আমরা দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষাক্রমের সহায়ক কাজ (extracurricular activities) হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মূল কাজ অধ্যয়ন, সংস্কৃত ভাষায় যেটা বলা হয়েছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’- অধ্যয়নই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের একমাত্র কাজ। ধ্যানে বসলে যেমন অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করা যায় না, তেমনি শিক্ষার্থী হলে শিক্ষাগ্রহণ ব্যতীত অন্যদিকে মনোনিবেশ করা ঠিক নয়। শিক্ষালাভের মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের জন্য প্রস্তুত করাই হলো শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যচ্যুতি ভালো ফল বয়ে আনবে না।
তাই বলে আমরা বলছি না, শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করতে পারবে না বা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পক্ত হতে পারবে না। মানুষ রাজনীতিসচেতন জীব। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই রাজনীতি শিখতে হবে। তাদের রাজনীতিটা কী হবে, সেটা তাদের ও সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরা দরকার বলে আমরা মনে করি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে) যে ছাত্র সংসদ রয়েছে, সেগুলো হতে পারে তাদের জন্য রাজনীতিচর্চার সূতিকাগার। সে রাজনীতি কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় নয়, তাদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ছাত্রসমাজের স্বার্থরক্ষায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্যই পরিচালিত হবে। এতে একদিকে যেমন তাদের রাজনৈতিক সাক্ষরতা ও সক্ষমতা তৈরি হবে, তেমনি তারা রাজনীতির মৌলিক মূল্যবোধ তথা সামষ্টিক কল্যাণকে ধারণ ও লালন করার সুযোগ পাবে। তখন জাতীয় পর্যায়ের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও সহজেই তাদেরকে কলুষিত করা যাবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ ক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ছাত্র সংসদগুলোতে সুষ্ঠু রাজনীতিচর্চার সুযোগ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। সামষ্টিক কল্যাণে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল ন্যায়সংগত দাবি পূরণে এই সংঘশক্তি প্রতিনিয়ত সচেষ্ট থাকবে। তা ছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সংলগ্ন এলাকায় (catchment area) সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক উন্নয়নে কাজ করতে পারবে। তাহলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এর একদিকে যেমন গ্রহণযোগ্যতা এখনকার মতোই অক্ষুণ্ন থাকবে, অপরদিকে যেকোনো পরিবর্তনের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি অনন্য প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষার্থীদের ও জাতীয় স্বার্থে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান (social institution) হিসেবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজে লাগিয়ে বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের যে স্বপ্ন ছাত্র-জনতা লালন করছে, তাকে বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার দ্বিতীয় মুক্তির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যেমন ধারণ করবে, তেমনি রাষ্ট্র বিনির্মাণের একটি অনন্য শক্তি হিসেবে কাজ করবে। অপরদিকে একে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করলে এটা তার মৌলিকত্ব যেমন হারাবে, তেমনি হারাবে এর বর্তমান সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা’ তুলতে গিয়ে দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সম্পৃক্ত সবাইকে আলোচিত বিষয়গুলো ভেবে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক : ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য