লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা শেষে চার মাস পর ৬ মে মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সঙ্গে এসেছেন তার দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়েই দেশে ফেরার যে গুঞ্জন ছিল, তা গুঞ্জনই রয়ে গেল। এ অবস্থায় সম্ভাবনা আরও গাঢ় হচ্ছে দলের হাল ধরতে এই দুই নারী এগিয়ে আসবেন কি না তা নিয়ে। দলীয় সূত্র বলছে, দেশে ফিরলেও রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন না বিএনপির চেয়ারপারসন। জল্পনা রয়েছে, তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান দলের হাল ধরতে পারেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর শাশুড়ি খালেদা জিয়ার সঙ্গেই দেশে ফিরেছেন তিনি।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে যান ডা. জুবাইদা রহমান। দ্বিতীয় দফা সময় বাড়িয়েও পেশায় চিকিৎসক জুবাইদা দেশে ফিরে কাজে যোগ না দেওয়ায় বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও বিষয়টি নিয়ে বিএনপির অভিযোগ আছে। সিলেটের একটি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা জুবাইদাকে নিয়ে এবার বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
বিগত ১৭ বছর ‘ক্লিন ইমেজের’ হিসেবে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের বিকল্প হিসেবে জুবাইদা রহমান দলের হাল ধরবেন কি না, তা নিয়ে চর্চা কম হয়নি। তবে এ বিষয়ে খালেদার পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া এবার লন্ডনে গেলে অনেক দিন পর আবার সামনে আসেন জুবাইদা। সব সময় তাকে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা গেছে। বাসায়ও শাশুড়িকে সেবা করেছেন। দেশে ফেরার সময়ও তিনি সঙ্গ দিয়েছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকবেন বলে জানিয়েছে দলীয় একটি সূত্র।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পেছনে প্রধান অন্তরায়। সে ক্ষেত্রে জিয়া পরিবার থেকে তারেক রহমানের পাশাপাশি জুবাইদা রহমানও সামনে আসবেন কি না, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আছে নানাবিধ আলোচনা।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, দেশে এসে রাজনীতিতে জড়াবেন নাকি গৃহিণী হিসেবে ঘর সামলাবেন জুবাইদা, সেটি বলার সময় এখনো আসেনি। অনেকের ধারণা, তারেক রহমানের দেশে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই ঢাকায় এসেছেন তিনি।
দলীয় কর্মীদের একটি অংশ মনে করছে, জুবাইদা রহমানের নেতৃত্বে একধরনের সৌম্য, শালীন ও উচ্চশিক্ষিত প্রোফাইল তৈরি হতে পারে, যা বিএনপিকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
জুবাইদা রহমানের জন্ম বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। তিনি প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলীর মেয়ে। মাহবুব আলী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারের সময়েও তিনি যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী জুবাইদা রহমানের আপন চাচা।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান। দুই কন্যার মা শর্মিলা দলীয় রাজনীতিতে কখনোই সরাসরি যুক্ত হননি। তবে কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার যত্নে তার অনুপম উপস্থিতি এবং পারিবারিক নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠা এটি এখন রাজনৈতিক মূল্য পাচ্ছে। তিনি দলের নেতৃত্বে আসবেন কি না, তা অনিশ্চিত। কিন্তু তার প্রতি নেত্রীর নির্ভরতাই তাকে রাজনৈতিক গুরুত্ব এনে দিচ্ছে।
সৈয়দা শর্মিলা রহমান সব সময় পর্দার আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেছেন। রাজনীতির মাঠে তাকে দেখা যায়নি বললেই চলে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার রাজনীতিতে আসা নিয়েও চলছে জোর চর্চা। নেতৃত্বে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও পারিবারিক ঐতিহ্যের নিঃশব্দ উত্তরাধিকার তিনি বয়ে চলেছেন। বিএনপির অভ্যন্তরে একটি অংশ মনে করে, সৈয়দা শর্মিলা রহমানের এই ত্যাগ ও বিশ্বাসযোগ্যতা তাকে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, পরিচ্ছন্ন ইমেজের এই দুই নারী যদি এগিয়ে আসেন, তবে সেটি হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। অদূর ভবিষ্যতে যদি বিএনপির নেতৃত্বে জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমানকে দেখা যায়, তবে সেটি হবে কেবল এক পরিবারের জয় নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের এক নতুন অধ্যায়।
তবে দুই পুত্রবধূর মধ্যে বেশি আলোচনা ডা. জুবাইদাকে ঘিরে। তারেক রহমানের আগে জুবাইদা রহমানের আগমনকে ঘিরে অনেকের মাঝে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। এটি কি নিছক শাশুড়ি খালেদা জিয়ার সঙ্গী হওয়া, নাকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর পাশে থাকা? তবে বহু বছর ধরে তার বিএনপিতে সক্রিয় হওয়ার যে গুঞ্জন ছিল, তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, সিলেট অঞ্চলে জুবাইদা রহমানের অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে তিনি রাজনীতিতে আসবেন কি না, তা আমার জানা নেই। তিনি যদি রাজনীতিতে আসতে চান, তাহলে স্বাগত জানাব।
যদি ডা. জুবাইদা রহমান সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন, তাহলে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন একটি সমীকরণ সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তিনি দীর্ঘদিন একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন এবং রাজনীতির নানা স্তরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ফলে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া তার জন্য খুব একটা চ্যালেঞ্জ হবে না। তারা বলছেন, ডা. জুবাইদা রহমানের সক্রিয় রাজনীতিতে আসা বিএনপির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দীর্ঘদিন ধরে দলটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে একটি নৈতিক ও সাংগঠনিক শূন্যতায় ভুগছিল। তার উপস্থিতি এই শূন্যতা অনেকটাই পূরণ করতে পারে। এতে বিএনপির অভ্যন্তরীণ ঐক্য, নৈতিক ভিত্তি এবং জনসমর্থন পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।