আদি বাঙালি সংস্কৃতির মূল ভিত্তি গ্রাম-বাংলা। আর অর্থনীতির ভিত্তি ছিল গ্রামীণ অর্থনীতি। এরই সূত্র ধরে জীবনের নানা স্তরে ধাপে ধাপে বহু স্মৃতিময় ঘটনার আবরণ আমাদের তাড়া করে, শুদ্ধ হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পথনির্দেশনা দেওয়া প্রকৃতির নিয়মে ফিরে আসা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি দিনÑতৃষ্ণার্ত এ জীবনের পরশ পাওয়া। স্বমহিমায় নিজেকে উজাড় করে সৃষ্টিসুধায় কী যেন বলা না-বলার কালাকানুন ভেদ করে প্রবাহিত স্রোতোধারার মতো বয়ে চলে অবিরাম।
বৈশাখ আমার বৈশাখ। আগামী বিনির্মাণের প্রত্যয়ে সূচিত পথচলার প্রেরণাÑপহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মনুষ্যত্ব বিকাশের অদম্য শক্তি। আমাদের অতিপরিচিত বাংলার সুগন্ধমাখা বৈশাখ আসে প্রতিবছর। এ যেন বৈচিত্র্যময় এক আবহে জীবনে মনে অবারিত বহমান উতলা এক পশলা মিষ্টি হাওয়া। এ থেকে আমরা ভাবতে শিখিÑঅর্জন আর বর্জনের সেই সব দিনপঞ্জি। জীবনবোধের এ এক ভিন্নতর বিশ্লেষণ। যার সূত্র ধরেই আমাদের সমর্থন, গ্রহণ আর অর্পণ। আজকের এই সময়ে প্রাসঙ্গিকতায় উজ্জ্বল এক জানা সাধারণ ঘটনা আরও একবার উল্লেখ করতে মনের তাগাদা অনুভূত হয় যে, পহেলা বৈশাখ আমাদের বড় আপন আর এ আমাদের একান্ত নিজস্ব।
রাজাদের শাসন-শোষণ সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত আছে। এমনই এক রাজা আকালের বছরে তার দুঃখী প্রজাদের জন্য উৎপাদিত সব ফসল বিলিয়ে দিয়েছিলেনÑসুসময়ে ফেরত পাওয়ার শর্তে। একদিন সেই রাজা দৈবপ্রাপ্ত হলেন চৈত্রের কঠিন দিনের পর ফসলপ্রাপ্তির দিন হবে পহেলা বৈশাখÑবাংলা বছরের শুরুর দিন। বৈশাখের উৎস সম্পর্কে আরও জানা যায়, বাংলা নববর্ষের নাম প্রথমে ছিল ফসলি বছর। দীর্ঘ ইতিহাস না টেনেও বলা যায়, অতীতে হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করা হতো। হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের ওপর ভিত্তি করে হওয়ায় কৃষি ফসলের সঙ্গে খাজনা দেওয়ার নিয়ম প্রজাদের সীমাহীন কষ্টের কারণ হয়েছিল। সে কারণে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের সময় থেকে পহেলা বৈশাখ উদ্্যাপন শুরু হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা শোধ দিতে হতো। আর জমির মালিকেরা বছরের সেই প্রথম দিনে প্রজাদের মিষ্টান্ন মুখে দিয়ে হালখাতা খুলত। নতুন ফসলপ্রাপ্তিতে ঘরে ঘরে উদ্্যাপিত হতো নতুন বছরের আবাহন।
পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে, আদি বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি গ্রাম-বাংলা, গ্রাম-বাংলার খাদ্যাভ্যাস, পরিধেয় বস্ত্র, লোকাচার, সামাজিক রীতি-নীতির অংশ হয়ে যায়। দুধে-মাছে-ভাতে বাঙালি হয়ে খিচুড়ি, সস্তা মিঠাই, পান্তা-পায়েস আর ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি-লুঙ্গি, পাজামা-পাঞ্জাবি, মসলিন শাড়ি আর জারি-সারি পুঁথিপাঠ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
বাঙালিয়ানার এই সূত্র ধরেই আজ আমরা স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে এসেও বিশ্বের সর্বত্র বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাঙালিত্ব বিকাশে অগ্রগামী। আজ আমরা তাই তো বিশ্ব বাঙালি। বিশ্বের যেখানেই আমরা অবস্থান করি, বাংলা বছরের এই প্রথম দিনে স্মরণে আসে ফেলে আসা গ্রামের বাড়ির নিকোন উঠান আর মেলায় বাঁশের বাঁশির মিষ্টি সুর। রং-বেরঙের পুতুল আর সাধারণ মানুষের মুখে প্রাণখোলা হাসিসহ রকমারি খাবারের মন-মাতানো গন্ধ। সেখানে ছিল না কারও অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, ধর্মভেদ।
-নিউইয়র্ক।