মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী পরপর বা গ্যাপ দিয়ে, যেভাবেই হোক, দুই মেয়াদের বেশি কেউ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। সংবিধানের মেয়াদ-সংক্রান্ত এই বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছার বার্তা বা টেলিগ্রাফ সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন মহলে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হতে দেখা যায়।
১৯ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে (CPAC) ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিভ চ্যানন এ বিষয়ে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, The Future of America is MAGA, and the future of MAGA is Donald J Trump. We want Trump in 2024! তার এ বক্তব্য সম্মেলনে উপস্থিত রক্ষণশীল নেতাকর্মীদের দ্বারা বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়। ট্রাম্প নিজেও ইতিপূর্বে তার তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অভিলাষ নিয়ে একাধিকবার কথা বলেন। ফ্লোরিডায় হাউস রিপাবলিকানদের সম্মেলন, ডিসিতে ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট এবং অতিসম্প্রতি হোয়াইট হাউসে ব্ল্যাক হিস্টি মান্থ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অভ্যাগতরা তার মুখে এ কথা শুনে ‘Four more years’ ধ্বনি তুলে তাকে স্বাগত জানান।
ট্রাম্প সমর্থক রিপাবলিকানদের মধ্যে তার থার্ড টার্ম ধারণার প্রতি যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গেলেও ডেমোক্র্যাট ও অন্য একাধিক মহল এই ধারণার ঘোর বিরোধিতা করে মতামত দেন। ট্রাম্প সমর্থকদের মতে, দেশে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকা জরুরি। এ প্রসঙ্গে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি অগলেস (টেনেসি) জানান, ‘He (Trump) has proven himself to be the only figure in modern history capable of reversing our nations decay and restoring America to greatness and he must be given time necessary to accomplish that goal.’ অন্যদিকে ট্রাম্পের বিরোধী মহল এর ফলে স্বৈর ও রাজতান্ত্রিক মনোবৃত্তির ব্যাপক বিস্তারের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
মার্কিন সংবিধান সরকারের তিনটি শাখা নির্বাহী তথা প্রেসিডেন্ট, কোর্ট ও আইনসভাকে সমমর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাহী প্রধান প্রেসিডেন্ট যাতে বল্গাহীনভাবে তার ক্ষমতার ব্যাপ্তি ঘটাতে ও প্রয়োগ করতে না পারেন, তা ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ‘চেকস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ’ মার্কিন গণতন্ত্রের অনন্য এক রূপ, যা অন্য কোনো গণতন্ত্রে তেমনভাবে দেখা যায় না। একাধিক ফেডারেল এজেন্সির বিলোপ ও সংকোচন ও বিপুলসংখ্যক নবীন-প্রবীণ ফেডারেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছাঁটাইসহ ট্রাম্পের আরও কিছু পদক্ষেপকে কোর্ট যেভাবে স্থগিত করে দিয়েছেন, তা থেকে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায়, যদিও ট্রাম্পকে কোর্টের এ ধরনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তার মতে, রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয়, অপব্যবহার ও জালিয়াতি রোধ এবং বিভিন্ন ক্ষোভে বড় পরিবর্তনের জন্য জনগণ তার পক্ষে রায় দিয়েছেন। সে কারণে সেসব পরিবর্তনের বিপক্ষে কোর্ট সিদ্ধান্ত দিলে কোর্টের বিচারকদের নিয়ে তাকে ভাবতে হবে, যেটাকে ট্রাম্পের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে অনেকে অভিমত দেন।
দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে ট্রাম্প ইউক্রেন ও ফিলিস্তিন যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধসহ মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও এসব ক্ষেত্রে তার সাফল্য এখনো দৃশ্যমান নয়। উল্টো এসব ক্ষেত্রে তার কিছু পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে সহায়ক হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর জন্য রাশিয়া ও পুতিনকে দায়ী না করে ট্রাম্প এর জন্য ইউক্রেন ও সে দেশের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে দায়ী করেন। ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধ ও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওই অঞ্চলে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতি থেকে সরে এসে গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ অধিবাসীকে উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠিয়ে গাজা উপত্যকায় মালিকানা নিয়ে সেখানে রিভিয়েরা স্থাপনের জন্য তার পরিকল্পনা শান্তিকে সুদূরপরাহত করতেই কেবল সহায়ক হবে, যদিও আরব বিশ্ব, বিশেষ করে মিসর ও জর্ডানের তীব্র আপত্তি ও বিরোধিতার মধ্যে ট্রাম্প পরে এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিতা জর্জ ওয়াশিংটন দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার পর স্বেচ্ছায় তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট না থাকার সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্রে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের বহাল থাকার রীতি ও ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এই রীতি বহাল থাকে। ১৯৩২ সালে মহামন্দার (Great Depression) সময় ডেমোক্র্যাট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর এক বছর পর ১৯৪০ সালে এবং যুদ্ধ চলাকালে পরে ১৯৪৪ সালে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। চার মেয়াদে তিনি মোট ১৩ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। স্পষ্টত, সে সময়কার বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে দুই মেয়াদের বেশি সময় ধরে তার প্রেসিডেন্ট থাকা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য বা ওজর-আপত্তি উঠতে দেখা যায়নি। ১৯৪৫ সালে রুজভেল্টের মৃত্যু হলে হ্যারি ট্রুম্যান প্রেসিডেন্ট হন। এ সময় মার্কিন কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের মেয়াদ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে, যার ফলে মার্কিন সংবিধানে ১৯৫১ সালে ২২তম সংশোধনী যুক্ত করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদে থাকার সিদ্ধান্ত হয়।
ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার ইচ্ছা তাকে খবরের শিরোনামে রাখতে সহায়ক হলেও তৃতীয় মেয়াদে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সংবিধানের ২২তম সংশোধনী বাতিলের জন্য কংগ্রেসের কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন ছাড়াও এই সংশোধনী বাতিল প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের আইনসভার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ট্রাম্পের তিনবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
লেখক : কলামিস্ট