পে-চেক প্রটেকশন প্রোগ্রামের (পিপিপি) লোনের অর্থ দিয়ে বাড়ি কেনার অভিযোগে বাংলাদেশি একজন উবার চালকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি কার্যালয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পিপিপি ঋণের অর্থে বাড়ি কিনেছেন, এমন বাড়ি মালিকের সংখ্যা অহরহ। ফলে তাদের অনেকেই আগেভাগে আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, পিপিপি লোনের অর্থে কেনা বাড়ি মালিকদের খুজছে ফেডারেল গোয়েন্দারা। নানাভাবে তারা তথ্য সংগ্রহ করছে। ডাটাবেজের পাশাপাশি গোয়েন্দারা প্রতিবেশীর কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে।
একটি সূত্র জানায়, কোভিড মহামারীতে ব্যবসায়িক ক্ষতি পোষাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পে-চেক প্রটেকশন প্রোগ্রামের (পিপিপি) আওতায় ঋণ সুবিধা দেয় ব্যবসায়ীদের। উবার চালক থেকে নানান পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা এই অর্থ পাওয়ার পর সঠিক কাজে ব্যয় করেননি। বেশিরভাগই বাড়ি কিনেছেন। কিনেছেন দামী গাড়িও। কিন্তু তাদের এই বিলাসী জীবন এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেডারেল গোয়েন্দা তাদের খুঁজে বের করে মামলা দায়ের করছেন। অভিযোগ প্রমাণ হলে জেল-জরিমানাসহ ফেরত দিতে হবে সমূদয় অর্থ।
পিপিপি লোনের প্রায় আড়াই লাখ ডলার ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনার অভিযোগ উঠেছে জ্যামাইকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবির (৫৩) নামে এক উবার চালকের বিরুদ্ধে। পিপিপির অর্থ দিয়ে তিনি নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায় তিনটি বাড়ি কিনেছেন-এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছে কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি কার্যালয়।
মামলার খবর পেয়ে গত ২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার কুইন্স কাউন্টির ১০৩ পুলিশ স্টেশনে আত্মসমর্পণ করেন উবার চালক হুমায়ূন। পরে তাকে কুইন্স ক্রিমিনাল কোর্টে হাজির করা হয়। আগামী ২৬ জানুয়ারি হাজিরা দেওয়ার শর্তে তাকে জামিন দিয়েছে আদালত।
কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি মেলিন্ডা ক্যাটজ একটি মিডিয়াকে জানান, উবার ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হওয়ার কথা বলে হুমায়ূন কয়েক দফায় দুই লাখ ৪৬ হাজার ডলার ঋণ নেন। সেই অর্থ দিয়ে নিউইয়র্ক নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে তিনি তিনটি বাড়ি কিনেছেন। এফবিআইসহ বিভিন্ন সংস্থার তদন্তের পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
মেলিন্ডা ক্যাটজ বলেন, ২০২০ সালের জুনে ইকনোমিক ইনজুরি ডিজাস্টার লোন (ইআইডিএল) পেতে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসনে (এসবিএ) আবেদন করেন হুমায়ূন কবির। সেখানে নিজেকে নিউইয়র্ক সিটির পরিবহন খাতের কর্মী হিসেবে বর্ণনা করেন। তখন ৫০ হাজার ১০০ ডলার ঋণ পান তিনি। এরপর ২০২১ সালের মার্চে ‘পে-চেক প্রটেকশন প্রোগ্রাম (পিপিপি)’র জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসনে আরেকটি আবেদন করেন হুমায়ূন। এ আবেদনে নিজেকে তিনি উবার চালক হিসেবে দেখান। এ দফায় তিনি ২০ হাজার ৮৩৩ ডলার ঋণ পান।
দুই মাস বাদে একই কর্মসূচি থেকে ঋণের জন্য ফের আবেদন করেন হুমায়ূন। তখন ক্ষুদ্র ঋণ প্রশাসন তাকে আরো ২০ হাজার ৮৩৩ ডলার ঋণ দেয়।এরপর অগাস্টে ইকনোমিক ইনজুরি ডিজাস্টার লোনের পরিমাণ বাড়ানোর আবেদন করেন তিনি। তখন ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ১০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ ৫৫ হাজার ২০০ ডলার করা হয়। পরে আরেকবার বাড়িয়ে করা হয় দুই লাখ ৫ হাজার ৩০০ ডলার।
ঋণ নেওয়ার সময় হুমায়ূন কবির প্রত্যেকবারই অঙ্গীকারনামায় বলেন যে, ব্যাপক ক্ষতির শিকার ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে ঋণের অর্থ ব্যয় করবেন।
কোভিড মহামারীর সময় যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে চাঙ্গা করতে কখনো বিনা সুদে, কখনো নামমাত্র সুদে; এমনকি ঋণের অর্থ শর্ত অনুযায়ী ব্যয় করলে তা আর ফেরত দেওয়া হবে না- এমন সব সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়। ওইসময় নিউইয়র্কের বিপুলসংখ্যক মানুষ মিথ্যা তথ্য দিয়ে পিপিপি ও ইআইডিএল কর্মসূচির অর্থ তছরুপ করেছেন বলে আলোচনা আছে।
এফবিআইসহ বিভিন্ন সংস্থা মাঠে নেমে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে, ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। অপকর্মের সহযোগিতাকারী সিপিএ ফার্মসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়েছে কী না তা খতিয়ে দেখতে গত বছরের মার্চ থেকে তদন্তে নামে নিউইয়র্ক স্টেট ফ্যাইন্যান্সিয়াল ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দারা। এফবিআইসহ অন্যান্য সংস্থাও এই তদন্তে শামিল হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই উবার চালক হুময়িূনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি কার্যালয়।
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি মেলিন্ডা ক্যাটজ বলেন, এসবিএ থেকে নেওয়া মোট দুই লাখ ৪৬ হাজার ৯৬৬ ডলারের পুরোটাই বাড়ি কেনাতে ব্যয় করেছেন হুমায়ূন। বিষয়টি ব্যাংকের বিবরণীতে স্পষ্ট হয়েছে। হুমায়ূনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেসব প্রমাণিত হলে তার ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি ‘প্রতারণামূলকভাবে’ তোলা অর্থও ফেরত দিতে হবে।
এর আগে করোনা মহামারী পিপিপি লোনের প্রায় এক মিলিয়ন ঋণ নিয়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার দায়ে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে বাংলাদেশি নির্মাণ ঠিকাদার বাবা-ছেলে অভিযুক্ত হয়েছেন। তারা হলেন- নিউইয়র্কে আঞ্চলিক সংগঠন সন্দ্বীপ সোসাইটির বর্তমান উপদেষ্টা নূরুস সাফা ও তার ছেলে মাইদা সাফা। মিথ্যা তথ্য দিয়ে লোন নিয়ে দুটি বাড়ি ও বিলাসবহুল বিএমডবিডব্লিউ গাড়ি কেনেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে ব্রকলিনের সিনিয়র সহকারী জেলা অ্যাটর্নি সের্গেই মার্টস-এর আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই মামলায় তাদের ১০ থেকে ২৫ বছরের সাজা হতে পারে।
এদিকে ভূয়া অফিস ও কর্মী দেখিয়ে পিপিপি লোন নিয়ে অভিজাত বাড়ি ও বিলাসবহুল গাড়ি কিনে রাতারাতি সমাজসেবক হওয়ার খবর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নানা সময় আলোচনার খোরাক হয়েছে। অনেকে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। কেউ ব্যবসার মালিকানা পরিবর্তন করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। ফেডারেল গোয়েন্দাদের জালে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে ধরা পড়েছেন। কেউ আছেন নজরে। এখন ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পাচ্ছে।