থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সম্প্রীতির বন্ধন জোরদারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। খরা-অনাবৃষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে বিগত বছরের শস্য রক্ষা ও কর্তন এবং বিশ্ব প্রকৃতির অফুরন্ত আশীর্বাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে প্রতিবছর নভেম্বরের চতুর্থ বুধবার উভয় দেশের জনগণ বর্ণাঢ্য আয়োজনে এই বিশেষ দিবসটি উদ্্যাপন করে থাকে। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, ধর্মযাজক মালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব তৎকালীন যুক্তরাজ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল এবং মানুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণে অনুপ্রাণিত করেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সূচিত হওয়ার পর গির্জার পুরোহিত ও যাজক সম্প্রদায়ের জীবনে শোচনীয় দুর্বিপাকের ঝড় বইতে শুরু করল। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে গির্জার দিগ্্বিদিকজ্ঞানশূন্য যাজক ও পুরোহিতগণ পালতোলা নৌকাযোগে নিরুদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন। ইংল্যান্ডত্যাগী এসব যাজক ও পুরোহিত পরবর্তী সময়ে পিলগ্রিমস বা তীর্থযাত্রী হিসেবে সামাজিক পরিচিতি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডত্যাগী যাজকদের একটি ক্ষুদ্রাংশ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পরিশেষে সৌভাগ্যবশত প্লাইমাউথ এবং ওয়ামপানোআগে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। জগদীশ্বরের অফুরন্ত আশীর্বাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দে শস্য উত্তোলন শেষে প্লাইমাউথ ও ওয়ামপানোআগের ইংরেজ ঔপনিবেশিক তীর্থযাত্রীরা সর্বপ্রথম থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদ্্যাপনের সূচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা নভেম্বরের চতুর্থ বুধবার থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদ্্যাপন করে আসছেন। সেই হিসেবে এ বছর ২৭ নভেম্বর বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা থ্যাঙ্কস গিভিং যে উদ্্যাপনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বলে শোনা যায়। অবশ্য কালের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় প্রবাদপ্রতিম ও ঐতিহ্যবাহী থ্যাঙ্কস গিভিং ডে অনুষ্ঠানমালার সঙ্গে ভূরিভোজের আয়োজনও প্রাধান্য পায়। আর খাদ্য তালিকায় টার্কি, ব্রেড স্টাফিং, পটেটো, ক্রেনবেরিজ, কুমড়ার পাই ইত্যাদি মুখরোচক খাবার এবং বিভিন্ন ধরনের পানীয় স্থান পায়। এই বিশেষ দিবসটি উপলক্ষে আমেরিকানদের কর্মচাঞ্চল্য এবং প্রাণসজীবতা হাজার গুণ বেড়ে যায়। সর্বত্র কেনাকাটার ধুম পড়ে। স্বজনেরা থ্যাঙ্কস গিভিং ডের অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে ভূরিভোজন ছাড়াও আমোদ-প্রমোদ, নাচ-গান, আদর-আপ্যায়ন এবং সব ধরনের হাসিখুশিতে মেতে ওঠে। বৃদ্ধাশ্রম, হসপিস ও বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অবস্থানরত স্বজনদের খোঁজখবর নিতেও আমেরিকানরা কৃপণতা করেন না।
ধারণা করা হয়, পাতিহাঁস বা বুনোহাঁসের তুলনায় টার্কি বা কুক্কুট-জাতীয় পাখি শিকার করা সহজসাধ্য ছিল বলেই প্লাইমাউথের অল্প কয়েকজন ঔপনিবেশিক বাসিন্দা টার্কি দিয়েই থ্যাঙ্কস গিভিং ভোজের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক টার্কি জবাই করতেন এবং সপ্তাহ ধরে তা ক্রেতাদের নিকট বিক্রি করতেন। এরপর ওয়ামপানোআগের ৯০ থেকে শতাধিক ব্যক্তি ব্যাপক হারে টার্কি জবাই এবং বেচা-বিক্রি শুরু করলেন। আবার ওয়ামপানোআগের বণিকেরা খাদ্যতালিকা দীর্ঘায়িত করলেন এবং এতে মুরগি, মাছ, বাইম মাছ, কাঁকড়া, শাকসবজি, বিয়ার ইত্যাদি সংযোজন করলেন। তবে প্লাইমাউথের উৎপাদনকারীদের খাদ্যতালিকা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হওয়ার প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারেনি।
এদিকে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে অনুষ্ঠানমালায় এক সশস্ত্র ব্যক্তি মদ্যপানের পর গুলি ছোড়ায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। হতভম্ব জনতা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকে আহত হলো এবং কয়েকটি শিশু মারাও গিয়েছিল। এ নিয়ে ইংরেজ এবং ওয়ামপানোআগের মধ্যে তর্কাতর্কি, হাতাহাতি এবং পরিশেষে খণ্ডযুদ্ধ বেধে গিয়েছিল। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় শত শত কলোনিস্ট এবং হাজার হাজার ন্যাটিভ আমেরিকান মারা গিয়েছিল। অবশেষে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কার্যকালে (১৬৭৫ থেকে ৭৬ সালে) এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতি ঘটল।
থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদ্্যাপনের পেছনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভিন্ন ধরনের ধ্যান-ধারণাও রয়েছে। জানামতে, দ্য নিউ ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিকরা সামরিক বিজয় এবং অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টির কবল থেকে নিজেদের কৃষিজাত ফসল রক্ষা পাওয়ায় জগদীশ্বরের আরাধনা-উপাসনার মধ্য দিয়ে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদ্্যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। যাহোক, আমেরিকান কন্টিনেন্টাল সংবিধানের অনুমোদন সাপেক্ষে কংগ্রেস জাতীয় থ্যাঙ্কস গিভিং ঘোষণা দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ১৭৯৮ সালের পর ইউএস কংগ্রেস স্টেটগুলোর জন্য থ্যাঙ্কস গিভিং বাদ দিয়েছিল। কেউ কেউ ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালা উদ্্যাপনে সরকারের অংশগ্রহণের আপত্তিও করেছিল। আবার দক্ষিণাঞ্চলীয় স্টেটগুলো নিউ ইংল্যান্ডের প্রথা গ্রহণে ঢিমে তেতালা গতি অবলম্বন করেছিল এবং অনেকে পার্টিশান বক্তৃতা প্যারেড নিয়ে যুক্তিতর্কের অবতারণা করল। তাই বলা যায়, থ্যাঙ্কস গিভিং ডে আমেরিকানদের ঐক্যের ডোরে আবদ্ধ না করে অনৈক্যের জালে জড়িয়ে ফেলল। যাহোক, গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৮৬৩ সালের ৩ অক্টোবর ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ২৬ নভেম্বর বুধবার থ্যাঙ্কস গিভিংকে জাতীয় দিবস উদ্্যাপনের ঘোষণা দেন। এদিকে কংগ্রেসের ১৯৪১ সালের সিদ্ধান্তের পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৯৪২ সালে নভেম্বরের চতুর্থ বুধবার থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদ্্যাপনের ঘোষণা দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানটি প্রতি নভেম্বরের চতুর্থ বুধবার উদ্্যাপিত হয়।
যুগ ও কালের পরিবর্তনে মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং মনোজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঢেউ খেলেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশেষ আশীর্বাদধন্য বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড। আবার বিশ্ব অভিবাসীর দেশ হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের বৃহত্তর অংশই মিশ্র সংস্কৃতির আমেরিকায় স্বতন্ত্র কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং হাজার বছরের ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে ভিন্নধর্মী মানুষে পরিণত হয়েছে। তাই গোড়ার দিকে থ্যাঙ্কস গিভিংয়ে ঈশ্বরবন্দনা প্রাধান্য পেলেও বর্তমানে এতে নানা সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। আর থ্যাঙ্কস গিভিং বিচিত্র ভাষাভাষী-বর্ণগোত্র ও ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মানুষকে একত্রিত হওয়ার বাহন হিসেবে কাজ করছে। অভিবাসীরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য না দিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে থ্যাঙ্কস গিভিং উদ্্যাপনে বিশেষ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। এদিকে ১৮৭৬ সালে ইয়েল বনাম প্রিন্সটন থ্যাঙ্কস গিভিংস ডে ফুটবল খেলার সূত্রপাত ঘটে। আঠারো শতকে শুরু হয় থ্যাঙ্কস গিভিং ডে প্যারেড। ১৯২০ সালে ফিলাডেলফিয়ার গিমবেল ডিপার্টমেন্ট সান্তা ক্লজসহ ৫০ জনকে দিয়ে প্যারেডের আয়োজন করেছিল। ১৯২৪ সালে, বিশেষত ১৯২৭ সাল থেকে বৃহদাকার বেলুনসহ নিউইয়র্ক সিটিতে অনুষ্ঠিত মেসির থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেডের জৌলুশ রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বস্তুত, পিলগ্রিমস এবং ন্যাটিভ আমেরিকানদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থ্যাঙ্কস গিভিং ডে ছুটি আন্তসাংস্কৃতিক শান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত এবং হানাহানি ও দ্বন্দ্বমুখর বিশ্বচরাচরে আমেরিকানদের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনকে জোরদার করার ক্ষেত্রে থ্যাঙ্কস গিভিং ডের অবদান নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উপলক্ষে ঠিকানার পক্ষ থেকে সবার প্রতি রইল একরাশ উষ্ণ শুভেচ্ছা। লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।