মার্কিন পুরুষদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অসংখ্য ভক্ত রয়েছে। অন্যদিকে প্রায় সমানভাবে নারীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় কমলা হ্যারিস। জেন্ডার সমতায় বিগত দশকে সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যেতে পারে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের নেতা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে নারী ও পুরুষ ভোটারদের পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করতে যাচ্ছেন কমলা হ্যারিস। আর দেশের সর্বোচ্চ আসনের এত কাছে আসা দ্বিতীয় নারী তিনি। তবে নিজের লিঙ্গ বা বর্ণকে পরিচয় হিসেবে ব্যবহার করেন না হ্যারিস।
সম্প্রতি সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কমলা হ্যারিস বলেছেন, ‘দেখুন, আমার বিশ্বাস এই পদের জন্য আমিই যোগ্য মানুষ। তাই নির্বাচনে লড়ছি। এখানে আমার লিঙ্গ বা বর্ণ মুখ্য বিষয় নয়।’ কিন্তু তার সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও জেন্ডার ইস্যুই তার প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে চলেছে।
মার্কিনিদের জন্য ‘ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট’ সম্পূর্ণ নতুন একটা বিষয় হতে পারে। এই নতুনত্ব অনেককে আকৃষ্ট করলেও, দেশটিতে এখনও অনেক মানুষ রয়েছে যাদের কাছে নারী নেতৃত্ব খুব একটা পছন্দনীয় নয়। ডেমোক্র্যাট শিবির অবশ্য এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে। তবে শেষ সময়ের জরিপে দেখা যাচ্ছে, ভোটারের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ‘সেক্সিজম’ রয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস, যা মানুষকে এক নারী প্রার্থীর পক্ষে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে পারে। ২০২৪ সালে এসে মানুষ অনেক চালাক হয়ে গেছে। সরাসরি নারীবিদ্বেষী কথা বলে তারা নিজেদের খারাপ মানুষ প্রমাণ করতে চায় না। এ ব্যাপারে আরেক ডেমোক্র্যাট কর্মকর্তা বলেছেন, ট্রাম্প না হ্যারিস- এই প্রশ্নের জবাবে বরং হ্যারিস বিরোধীরা বলেন, ওভাল অফিসের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ‘যোগ্যতা’ বা ‘ব্যক্তিত্ব’ নেই হ্যারিসের। একই সুর শোনা যায় রিপাবলিকান শিবির থেকেও। তাদের বিশ্বাস, ৫ই নভেম্বর ভোটাররা কমলাকে প্রত্যাখ্যান করবেন কারণ তিনি ‘দুর্বল, অসৎ, আর বিপজ্জনকভাবে উদারপন্থি’। এর সঙ্গে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর নারী হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।
তবে রিপাবলিকান শিবিরের এক সিনিয়র উপদেষ্টা আলাদাভাবে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ‘পুরুষ ভোটারদের ব্যাপক সমর্থনের কারণে’ ট্রাম্প জিততে যাচ্ছেন। আট বছর আগে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। ওই নির্বাচনে নারীবিরোধী মনোভাব বেশ স্পষ্টতই ফুটে উঠেছিল। ২০১৬ সাল থেকে নারীদের জন্য সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ২০১৭ সালের #মি ঠু প্রচারণা কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি হওয়া বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করেছে। হ্যারিসের মনোনয়ন পাওয়ার পেছনে এই আন্দোলনের প্রভাবও থাকতে পারে। তবে সাম্য, বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অনেক তরুণের মধ্যে আপত্তি রয়েছে। কারণ এতে তারা পিছিয়ে পড়ছেন বলে তাদের ধারণা।
অন্যদিকে নারীদের জন্য এসব পদক্ষেপ রক্ষণশীল মার্কিনদের কাছে পছন্দনীয় নয়। তারা নারি-পুরুষের জন্য তথাকথিত ‘জেন্ডার রোল’ মেনে চলতে আগ্রহী। ফলে, ৫ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একধরণের অলিখিত গণভোটে পরিণত হতে পারে, যার প্রেক্ষাপটে থাকবে দেশটির বর্তমানে নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান। আর এ ক্ষেত্রে কমবয়সী পুরুষদের কাছে পৌঁছাতে ট্রাম্পের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন কমলা হ্যারিস।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ জন ডেলা ভলপে বলেছেন, ‘কোনও প্রশ্ন করলেই নারীবিদ্বেষী, বর্ণবাদী ইত্যাদি হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হবে বলে সবসময় ভয়ে থাকে মার্কিন তরুণরা। তাদেরকে কেউ বুঝতে চাচ্ছে না যে- এই ধারণা থেকে হতাশা জন্মায় তাদের মধ্যে। এই শূন্যতা পূরণে তারা ট্রাম্প বা মাস্কের ‘ভ্রাতৃত্বের সংস্কৃতিতে’ (ব্রো কালচার) আকৃষ্ট হয়।’ এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে এক স্পষ্ট বিভাজন দিনে দিনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেক মার্কিন তরুণই আগে মনে করতোÑ লিঙ্গ সমতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাড়াবাড়ি করে থাকে। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, এই দৃষ্টিভঙ্গির তরুণের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মানুষের এই অসন্তোষের সুযোগ নিচ্ছেন ট্রাম্প। পুরুষদের মধ্যে বিরাজমান ক্ষোভ ও হতাশাকে পুঁজি করে শেষ কয়েকদিনের প্রচারণায় দ্বিগুণ উদ্যমে ‘পুরুষত্বের’ ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি দাবি করেছেন, ‘পুরুষত্ব হুমকির মুখে’।
এদিকে, অসস্তুষ্ট পুরুষদের সামলাতে যেন ‘অভিভাবকসুলভ শাসনের’ পথ বেছে নিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। যেমন- সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বক্তব্যে কিছুটা তিরস্কারের সুরে বলেন, নারী প্রেসিডেন্ট নিয়ে অনেক পুরুষের আপত্তি রয়েছে। সেজন্যই তারা হ্যারিসের যোগ্যতা নেই সহ আরও হাজারটা অজুহাত তুলে ধরছেন। আবার, অভিনেতা এড ও’নিল এক টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটু চটকদার ও স্পষ্ট এক বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘পুরুষ হোন: এক নারীকে ভোট দিন’ (বি অ্যা ম্যান: ভোট ফর অ্যা উইম্যান)। তো, নির্বাচনের শেষ কয়েকটা দিনে জেন্ডার ইস্যু যেন শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল। একই সঙ্গে আছে আবার নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরুষতন্ত্রের ঘোড়ায় চেপে সিংহাসনে আরোহণে বদ্ধপরিকর। আর ওদিকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হ্যারিস নারীত্বের বদলে যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী। নিউইয়র্ক টাইমসের এক জরিপে দেখা গেছে, পুরুষ ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তার দৌড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৪ শতাংশে এগিয়ে আছেন। আর নারী ভোটারদের মধ্যে হ্যারিস এগিয়ে আছেন ১২ শতাংশে।
ঠিকানা/এসআর