দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পর সেখান থেকে পতনের পর কারও মাথা ঠিক না থাকারই কথা। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, মোসাহেবি, অপরিসীম চাটুকারিতা ও বিপুল অর্থবিত্ত প্রাপ্তির পর হঠাৎ করে কেউ তা হারিয়ে ফেললে সে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আবোল-তাবোল প্রলাপ বকতে শুরু করবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে।
নিকট অতীতে স্বৈর মনোভাবাপন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখ থেকেও সে রকম হাস্যকর প্রলাপ আমরা শুনেছি। ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেনের কাছে হেরে এতটাই দিশেহারা হয়ে যান যে, তিনি সেই নির্বাচনের ফলাফলকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাকে ষড়যন্ত্র করে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনে হারানো হয়েছে জানিয়ে বক্তব্য প্রদান অব্যাহত রাখেন। মার্কিন নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিদের ভোটদানের সুযোগ দেওয়া, ভোটিং মেশিনে জালিয়াতির মাধ্যমে ভোট পরিবর্তন ইত্যাদি নানা ধরনের অভিযোগ করেন তিনি। যদিও সেসব অভিযোগের সত্যতা কোনো মহল থেকে পাওয়া যায়নি। এমনকি ভোটের ফলাফল উল্টে দিয়ে তাকে বিজয়ী করার জন্য এতটাই দিশেহারা হয়ে যান যে, নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে চাপ দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল সার্টিফাই না করার জন্য মার্কিন আইনসভা ভবনে (ক্যাপিটল হিল) নিজের সমর্থকদের লেলিয়ে দিয়ে এক রক্তাক্ত নজিরবিহীন ঘটনার অবতারণা করেন। সেই insurrection ঘটনায় পুলিশসহ কয়েক ব্যক্তি নিহত হন। এ ছাড়া তার অসংখ্য উগ্রবাদী সমর্থকের সহিংস অপতৎপরতায় সেদিন কংগ্রেস ভবনে সৃষ্ট নারকীয়তা থেকে কংগ্রেস সদস্যদের নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে উদ্ভন্তের মতো ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। মাইক পেন্স পরিবারসহ একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যেতে সক্ষম হন। মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে এটি একটি জঘন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ট্রাম্পের আরও অনেক নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের (সেক্স, বিজনেস রেকর্ড, স্ক্যান্ডাল ইত্যাদি) কারণে তাকে প্রতিনিয়ত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলাগুলোকে উদ্দেশ্যমূলক ও তাকে হয়রানির জন্য প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সাজানো হয়েছে অভিযোগ করে এসবের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছেন, পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পেলে তিনি তাদের দেখে নেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস ছাড়াও বিল ও হিলারি ক্লিনটন, জো বাইডেন, জন কেরি, অ্যাডাম শিফ, জ্যাক স্মিথ, আলভিন ব্রাগ, ফানি উইলিহ, মার্ক জুকারবার্গ প্রমুখ রয়েছেন। ক্ষমতা হারানোর ব্যথায় মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণে তার মুখ থেকে এহেন কথাবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মুখে ক্ষমতা হারানোর পর বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার মুখ থেকেও অনেকটা অনুরূপ কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, যা একাধিক ফোনালাপে ফুটে উঠেছে। একটি ফোনালাপে তিনি জানান, তিনি বাংলাদেশের কাছেই আছেন এবং চট করেই ঢুকে যেতে পারেন।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্ট পতনের পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। তার কথায় এটা মনে হতে পারে, বাংলাদেশে ঢুকে গেলে তিনি পুনরায় ক্ষমতার মসনদে আসীন হতে পারবেন। গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশ কিছু অভিযোগে তার এবং তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ৬০টির বেশি মামলা রুজু করা হয়েছে। এসব অভিযোগে তার ও তার দোসরদের বিচারের জন্য ইতিমধ্যে একটি অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। যার প্রসিকিউটররা বর্তমানে অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে নিয়োজিত রয়েছেন। ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল ১৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পৃথক দুটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দিয়েছেন। মামলাগুলোর যেকোনো একটিতে দোষী সাব্যস্ত হলে তার ১০-১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। কারাদণ্ড ভোগের পর নবতিপর শেখ হাসিনার পক্ষে রাজনীতির হাল ধরে হারানো প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা যে সহজসাধ্য হবে না, সেট বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার বর্তমান বয়স ৭৮ বছর।
৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পলায়নের আগের দিন গণভবনে সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে যে বৈঠক করেন, তাতে বিপ্লব দমনে তিনি পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের ভূমিকার প্রশংসা করে অন্যান্য বাহিনীর প্রধানেরা তার মতো পদক্ষেপ (গুলিবর্ষণ) গ্রহণ না করায় তাদের ভর্ৎসনা করেন। ওই বৈঠকের অডিও রেকর্ডসহ কার্যবিবরণী (মিনিটস) অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে রয়েছে। এতে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার হুকুমদাতা হিসেবে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সহজেই প্রমাণিত হয়ে যাবে। তা ছাড়া ডিবি হারুন, এসবির মনিরুলসহ অন্য কর্মকর্তাদের আদালতে cross examination-এর সময় প্রকৃত সত্য উঠে আসবে। এদিক দিয়ে বিচার করলে শেখ হাসিনার মামলাগুলোকে আদালতের ভাষায় Prima Facie বা পর্যাপ্তভাবে প্রমাণসমৃদ্ধ মামলা হিসেবে গণ্য করা যায়, যা প্রমাণ করতে আইনজীবীদের তেমন কোনো বেগ পেতে হবে না বলে প্রতীয়মান হয়।
অপর একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এক মাসও টিকবে না। যেসব কর্মকর্তা তার দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি করছেন, তাদের নাম-পরিচয় লিখে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। ‘এক মাঘে শীত যায় না’ উল্লেখ করে তিনি সময়মতো সকল হিসাব গুনে গুনে নেওয়া হবে বলে হুংকার দেন। তিনি আরও বলেন, গোপালগঞ্জের ওপর যারা হাত দেয়, তাদের হাত পুড়ে যায়।
শেখ হাসিনা বর্তমান সময়ের অন্যতম একজন নিষ্ঠুর ও ঘৃণিত স্বৈরশাসক। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে হাসিনার শাসনামলে হত্যা, গুমসহ নির্যাতনের সর্বাধিক সংখ্যক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর বিবরণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘ ইত্যাদি) রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে।
জার্মান দার্শনিক উইলহেম হেগেল বলেছিলেন, We learn from history that we learn nothing from history. অর্থাৎ ইতিহাসের শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নিই না। শেখ হাসিনাসহ অন্য অনেক স্বৈরশাসকের পতনের জন্য হেগেলের এই কথাটি যে কতটা নির্ভেজাল সত্য, সেটি বিশদে বলার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না।
লেখক : কলামিস্ট