আমি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। তার আগে ২০১৩-এর ১২ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রায় সাড়ে ছয় বছর থাকতে হয়েছে আমাকে। ফলে এই দীর্ঘ সময় বলতে গেলে বাংলাদেশের সঙ্গে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়েই ছিলাম আমি। ২০১৩-এর ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে বুকভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম! ২০০৬ সালের আগে দেশে যখন ছিলাম, জাতীয় অনেক অনুষ্ঠানে এমনকি হরতালে, আন্দোলনে, মিছিলে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গিয়েছি। একই সঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিও চালাতাম। তাই আমার জন্য দুঃসহ প্রবাসজীবন যাপনের অর্থ হলো, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে দারুণভাবে ‘মিস’ করা! ২০১৪ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি (বিশ্ব ভালোবাসা দিবস তথা ভ্যালেনটাইন ডে) বাংলাদেশের সঙ্গে আবার আমার দূরত্ব বেড়ে যায়! সেই বছর ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই ঢাকায় বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘একুশে বইমেলা’য় বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। বইমেলা চত্বরে ঘুরে ঘুরে ক্যামেরার শাটার টিপেছি। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে নিজেকে ঋদ্ধ করেছি। কিছু বইও সংগ্রহ করেছি এবং সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ঢাকার অনেক স্থানের, অনেক মানুষের ছবি ক্যামেরাবন্দী করেছি। তো একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কিছু বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে সম্প্রচারিত টিভি চ্যানেলগুলোর নাটক ও সংগীতানুষ্ঠানগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের অনুষ্ঠানের খোঁজখবর রাখার সুযোগও হয়নি। এমনকি যুক্তরাজ্যে দীর্ঘ সময় থাকার সময়ও ক্ষুন্নিবৃত্তি নিয়ে লন্ডনের বাইরে ব্যস্ত থাকার কারণে সেখানে বাংলাদেশিদের আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি।
তো আমেরিকায় এসে পরিবারসহ নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসে উঠি। ব্রঙ্কস থেকে নিউইয়র্কের ডাউনটাউনে বাঙালি অধ্যুষিত, বিশেষত জামাইকা, জ্যাকসন হাইটস এলাকায় অনেকবার গিয়েছি। বাংলাদেশিদের আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চেষ্টা করেছি। আমি ২০১৪ সালের ১৫ জুন আমার কন্যা শবনম অদিতিকে নিয়ে ছুটে গিয়েছি ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন, নিউইয়র্ক’ আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা ২০১৪’-তে।
সেবার নিউইয়র্ক বইমেলায় গিয়ে চমকে ওঠার পালা! এখানে এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ! বইমেলার ভেন্যুর বহির্ভাগজুড়ে আমেরিকা ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। এ চিত্র দেখে আপ্লুত হয়ে পড়লাম! আমাদের হৃদয়-মন জুড়িয়ে গেল! আগ্রহ নিয়ে প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম, অজস্র বাংলা বইয়ের বর্ণাঢ্য পসরা সেখানে! রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, আলবেয়ার কাম্যু, জীবনানন্দ, হুমায়ূন আহমেদÑআরও কত আলোকিত মানুষের অভিজ্ঞানের সমাহার! একজন মানুষকে দেখলাম, ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। জানতে পারলাম, তিনি মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা। দেখলাম চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরকে। তার ছবি তুললাম। আবার দেখলাম কবি মহাদেব সাহাকে এবং নাট্যাভিনেত্রী লুতফুন নাহার লতাকে। তাদের সঙ্গে নিজের ছবি নিলাম। তারপর দেখলাম আমার প্রিয় নাট্যজন জামালউদ্দিন হোসেন এবং তার সহধর্মিণী রওশন আরা হোসেনকে। তাদের দুজনকে আমরা সালাম জানালাম। হাসিমুখে তারা আমাদের প্রতি-সালাম জানালেন। দেখতে পেলাম, জামালউদ্দিন সাহেবের বুকে ঝুলছে একটি ব্যাজ। বুঝলাম, তিনি বইমেলাকে সফল করে তোলার দায়িত্ব পালন করছেন। বিষয়টি আমার বেশ ভালো লাগল। দর্শকনন্দিত এই নাট্যজন দেশ ছেড়ে এলেও দেশ কিন্তু তাকে ছাড়েনি! সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেননি! তার পক্ষে তা সম্ভব নয়! এটিই তো একজন শিল্পবোদ্ধার ক্ষেত্রে দেশকে এবং শিল্পকে ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত!
আমি জামালউদ্দিন সাহেবকে বললাম, ‘স্যার, আপনাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চাই!’ তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়।’ তারপর স্বামী-স্ত্রী দুজন তারা ‘পোজ’ নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেলেন! চটজলদি শবনম তাদের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। আমি তাদের তিনজনের ছবি তুললাম। তারপর শবনমের হাতে ক্যামেরা দিয়ে আমিও তাদের পাশে দাঁড়ালাম। শবনম আমাদের ছবি ক্যামেরাবন্দী করল। এখন সেই দুটো ছবি আমার মনের মণিকোঠায় স্মৃতিভাস্বর হয়ে আছে! বেদনাবিধুর মনে ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় সেগুলো দেখে আমাদের সঙ্গে তাদের উষ্ণ-সান্নিধ্য অনুভব করি অভাজন এই আমি!
সেই তখন, সেই বইমেলায় জানলাম, জামালউদ্দিন দম্পতি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। হয়তো সময়-সুযোগ পেলে দুজনই দেশে যান। তবে নিরবচ্ছিন্ন পরিসরে সেখানে থাকছেন না। তাই ক্যামেরার সামনে এবং নাট্যমঞ্চের ব্যাপ্তিতে নিজেদের সপ্রতিভ উপস্থিতি প্রকাশ করতে পারছেন না তারা! তাদের দর্শকদের মনোরঞ্জনে, নিজেদের দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে পারছেন না! ভাবলাম, সংগত কারণেই এখন তাদের অগণিত ভক্তজনেরা তাদেরকে আর নিয়মিত দেখতেও পারছেন না সিনেমায় রুপালি পর্দায় এবং টিভির নাটকে। বিষয়টি নিশ্চয় এই গুণীদের জন্যও প্রশান্তির নয়, স্বস্তিদায়ক নয়।
কী আর করা! জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের সবাইকেই তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এই যেমন দেখেছিলাম লুতফুন নাহার লতাকেও। জানলাম তার কথাও। তিনিও তো দেশে একজন ব্যস্ত দর্শকপ্রিয় নাট্যাভিনেত্রী ছিলেন। কবি মহাদেব সাহা, ফরিদুর রেজা সাগর আমন্ত্রিত হয়েই যোগ দিয়েছিলেন সেবারের বইমেলায়।
উত্তর আমেরিকার পত্রিকা মারফত জামালউদ্দিন সাহেবের অসুস্থতার সংবাদ জেনেছিলাম। তিনি ও তার সহধর্মিণী কানাডায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি ক্যালগিরির রকিভিউ হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে ‘লাইফ সাপোর্টে’ চলে যান। তার ত্বরিত সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু তার পরিবারের এবং ভক্তকুলের সবাইকে কাঁদিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে পরপারে চলে যান তিনি!
পত্রিকায় এ দুঃসংবাদটি দেখে হতবাক হয়ে গেলাম! বিশ্বাসও করতে পারছিলাম না। এত তাড়াতাড়ি, বড্ড অসময়েই চলে গেলেন তিনি! নাট্যজন জামালউদ্দিন হোসেনের মৃত্যুর দুঃসংবাদ সামাজিক মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আক্রান্ত মন নিয়ে আমার ‘মেমোরিতে’ রক্ষিত ছবিগুলো ঘেঁটে পেয়ে গেলাম ১০ বছর আগেকার সেই নিউইয়র্কের বইমেলার ছবিগুলো! সেখানে অন্যান্য ছবির সঙ্গে জামালউদ্দিন দম্পতির সঙ্গে তোলা আকাক্সিক্ষত ছবিটিও পেলাম!
একুশে পদকে ভূষিত, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-নাট্যাভিনেতা, নাট্য-পরিচালক তথা নাট্যজন শ্রদ্ধেয় জামালউদ্দিন হোসেনকে অকালে হারিয়ে আমার মতো তার গুণমুগ্ধ অগণিত ভক্তজনও নিশ্চয় ব্যথিত হয়েছেন। তিনি একজন সৃজনশীল মানুষ, তার গুণমুগ্ধ দর্শকদের সামনে এসে উপস্থিত হবেন না আর! আগামীতে আমরা তার কোনো নতুন সৃষ্টি দেখতে পাব না! কখনো না!
এ সময় আমরা সকলেই নাট্যজন জামালউদ্দিন হোসেনের প্রয়াত আত্মার স্বর্গীয় শান্তি কামনা করি। দোয়া ও প্রার্থনা করি। একই সঙ্গে তার সহধর্মিণী রওশন আরা হোসেনসহ পরিবারের সবাইকে জানাই গভীর সমবেদনা