Thikana News
২৩ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

প্রথমে আত্মশুদ্ধি  পরে জাতিশুদ্ধি

পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ, রাজনৈতিক দল গঠন এবং সেনা অভ্যুত্থানে জিয়ার প্রাণহানির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবেই জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অথচ রাজনৈতিক দল গঠনের পর দলীয় নেতাকর্মী-সেবাদাস-বশংবদদের ভাষায় তিনি রাতারাতি হয়ে ওঠেন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ ও পুরোধা, গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা।
প্রথমে আত্মশুদ্ধি  পরে জাতিশুদ্ধি
অবিভক্ত বাংলার সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বৈরুতের একটি হোটেলে ইন্তেকাল করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অবর্তমানে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের জেল-জুলুম-নির্যাতনকে উপেক্ষা করে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আর এটি ২৩ মার্চ অনানুষ্ঠানিক ঘোষিত হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি নিহত হন। ৬ দফা প্রণয়ন এবং ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব রাতারাতি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারবঞ্চিত জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন। অতঃপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ এবং ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে কারামুক্তির পর শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন।
এ পর্যায়ে শেখ মুজিবের গতিশীল নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব-প্রজ্ঞা সমসাময়িক লব্ধপ্রতিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক ও ভূয়োদর্শী রাজনীতিবিদদের ঔজ্জ্বল্য ও বিচক্ষণতাকে ম্লান করে দিয়েছিল। বিশেষত, রাজনৈতিক গুরু মওলানা ভাসানীসহ অনেক জাঁদরেল নেতৃবর্গের তীব্র বিরোধিতার মুখেও সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার অধীনে ১৯৭০/৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ব্যতিক্রমী দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৫৯টি আসনের মধ্যে ১৫৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৫টি লাভ করার পর মুজিবের রাষ্ট্রনায়কসুলভ দূরদর্শিতার খ্যাতি পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিস্তৃতি লাভ করে। এ পর্যায়ে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে এবং বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে তিনি ষোলকলা পুরো শশীর স্থান দখল করেন। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার উত্তরোত্তর বহিঃপ্রকাশ এবং বিশেষত একাত্তরের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমুদ্রের অলিখিত ঐতিহাসিক ভাষণ শেখ মুজিবকে বিশ্ববরেণ্য রাজনৈতিক নেতাদের পঙ্্ক্তিভুক্ত করে। তাই ঐতিহাসিক বৈদ্যনাথতলায় গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা হয় কারারুদ্ধ শেখ মুজিবকে।
এদিকে কারামুক্তির পর বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের একাধারে দলীয় প্রধান, রাষ্ট্রীয় কর্ণধার, সর্বেসর্বা জননেতা, দেশদরদি মহাপুরুষ, ত্রাতা, জনগণের ভাগ্যবিধাতা তথা ঐন্দ্রজালিক ও অলৌকিক শক্তির অধীশ্বর অর্থাৎ বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি বা শাহানশাহ বনে যান শেখ মুজিবুর রহমান। তার একক সিদ্ধান্তই দলীয় এবং সরকারের সিদ্ধান্ত হিসেবে অনুমোদন লাভ করে ও কার্যকর হয়। সারা দেশ ও দেশবাসীর ভাগ্যের উত্থান-পতন-পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সৃষ্টি-লয় সবকিছুই তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-জ্ঞানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। রাজাধিরাজ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ জাতীয়-রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শন ও আদর্শে রূপ নেয়। শেখ মুজিবের শৌর্যবীর্য-একাধিপত্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে দলীয় পর্যায় তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করার বুকের পাটা কারও ছিল না। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পুরোপুরি কুক্ষিগত করার পর মুজিবের অহংকার, ঔদ্ধত্যপনা ও স্বেচ্ছাচারিতা তুঙ্গে ওঠে এবং তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। বাকশাল গঠনের মাধ্যমে সারা জীবনের কারাবরণ-সংগ্রামের সোনালি ফসল গণতন্ত্রকে সমাধিস্থ করেন শেখ মুজিব স্বয়ং। দলীয় স্তাবক-সেবাদাস ও উচ্ছিষ্টভোগীদের দেব-বন্দনা উপেক্ষা করে নিখুঁত বাস্তবতাকে উপলব্ধির অক্ষমতা; রক্ষীবাহিনীর দমন-পীড়ন ও নিষ্ঠুর নির্যাতন; চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানি, দলীয় সাঙ্গপাঙ্গ-চামুণ্ডাদের লুণ্ঠন-নির্যাতন- বিচারহীনতা ইত্যাদি মাৎস্যন্যায় দশা শেখ মুজিবকে অন্তিম পরিণতির মুখে ঠেলে দেয়। এটি অনস্বীকার্য যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিজনে নিহত না হয়ে শেখ মুজিব স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলে তার অবর্তমানে দল-দেশ-রাষ্ট্র-সরকার সবকিছুর হয়তো-বা হাল ধরতেন তার বিধবা পত্নী কিংবা পুত্র-কন্যা-বংশানুক্রমে নাতি-নাতনি প্রমুখ। পারিবারিক তথা রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রায়ণের ধারাবাহিকতায় মুজিব পরিবারের বাইরে কেউই দল-দেশ-সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সোনার হরিণ হস্তগত করার স্বপ্নও দেখতেন না।
পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ, রাজনৈতিক দল গঠন এবং সেনা অভ্যুত্থানে জিয়ার প্রাণহানির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবেই জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অথচ রাজনৈতিক দল গঠনের পর দলীয় নেতাকর্মী-সেবাদাস-বশংবদদের ভাষায় তিনি রাতারাতি হয়ে ওঠেন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ ও পুরোধা, গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা। পত্র-পত্রিকার বর্ণনা অনুসারে জিয়ার শাসনামলে ক্যু-পাল্টা ক্যুতে হাজার হাজার সেনাসদস্য নিহত এবং ঢাকা থেকে এক রাতের জন্য সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়নি। অথচ দলীয় উচ্ছিষ্টভোগী ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর লেবাসধারী তথাকথিত দেশবরেণ্যদের ভাষায় জেনারেল জিয়া দেশের হাল না ধরলে মুজিব-পরবর্তী বাংলাদেশ রসাতলে যেত। রাষ্ট্রপতি জিয়া বিপন্ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন এবং দেশকে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। তাই পারিবারিক তথা রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রায়ণের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিয়ার অবদানকে প্রাতঃস্মরণীয় করে রাখা দল এবং জাতির নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই জেনারেল জিয়ার অবর্তমানে তার বিধবা পত্নী বেগম জিয়াকে এবং তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকেই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দল ও দেশের কান্ডারি মনোনয়ন করা হয়েছে। রাজনৈতিক গণতন্ত্রায়ণের ওই ধারা অব্যাহত থাকলে অনাগত ভবিষ্যতে জিয়া পরিবারের উত্তরসূরিরা বংশানুক্রমে দল ও দেশ পরিচালনার বৈধ এবং একচ্ছত্র দাবিদার। তাদের চিন্তা-চেতনা, নীতি-আদর্শ, ধ্যান-ধারণা দল, দেশ ও জাতির উন্নয়নের রোল মডেল এবং অভিজ্ঞান। দলের দায়িত্বশীল ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতা-নেত্রী এবং উৎসর্গীকৃত কর্মীদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে বিশেষণের বন্যা ছুটিয়ে দলীয় প্রধানের বক্তব্য ও আদর্শ দেশবাসীর কর্ণকুহরে পৌঁছে দেওয়া। দলীয় প্রধানের নীতি ও আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসে পড়ার অপরাধেও চাকরি নট। তাই দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত জাতীয় সংস্কার, দেশে উন্নতি ও সমৃদ্ধির জোয়ার বইয়ে দেওয়া ইত্যাদি চটকদারি ঢঙের বক্তব্যের নামে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় নেতারা কার্যত দলীয় প্রধানের স্তব-বন্দনা ও প্রশস্তি গেয়ে যাচ্ছেন হরহামেশা।
স্বৈরশাসক ও জাতীয় পার্টির প্রধান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ছিলেন দলীয় নেতা-নেত্রী-স্তাবক-বশংবদদের ভাষায় সর্বগুণে গুণান্বিত মহাপুরুষ। তিনি ইচ্ছামতো দলীয় নেতা-নেত্রী নিয়োগ দিতেন এবং পান থেকে চুন খসে পড়ার মতো অপরাধে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি নট করে দিতেন। আর রাজনীতির ফেরিওয়ালা বা তথাকথিত দলীয় অনুগত সেবাদাসরা সর্বদা পঞ্চমুখে এরশাদের প্রশংসা ও গুণকীর্তনে মত্ত থাকতেন। জনৈক রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টভোগী একদা এরশাদের বন্দনাকালে নির্লজ্জের মতো বলেছিলেন, সারা বিশ্বের গাছগাছড়া কলম, সাগরের পানি কালি এবং ভূপৃষ্ঠ কাগজ হয়ে গেলেও এরশাদের গুণাবলি লিখে শেষ করা যাবে না। যাহোক, নানা অপরাধে কারাভোগ করা সত্ত্বেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরশাদই ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রধান এবং তার পছন্দ-অপন্দেই দল পরিচালিত হতো। আর সেই সুবাদেই প্রয়াত এরশাদের পত্নী এবং ছোট ভাই দলীয় প্রধানের পদ নিয়ে গজকচ্ছপের লড়াই শুরু করেন এবং আদালতের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ওয়ারিশানের স্বত্ব নির্ধারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে প্রয়াত আবদুল মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর উত্তরাধিকারসূত্রে আওয়ামী লীগের সভাপতির আসন দখল করেন হাসিনা। তারপর দলীয় উচ্ছিষ্টভোগী, বশংবদ, স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী-আমলা-কামলার প্রত্যক্ষ মদদ ও সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। দলীয় স্তাবক ও বশংবদদের নিকট শেখ হাসিনা দেবদূত বা ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতাধর হিসেবে আবির্ভূত হন। জনৈক চাটুকার স্তাবক একদা অতিশয়োক্তিকালে বলেছিলেন, আমরা প্রত্যহ পবিত্র ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তে আমাদের নেত্রীর নাম জপে থাকি। যাহোক, পতিত স্বৈরাচার হাসিনার কাসুন্দি দীর্ঘায়িত করে রচনাকে তথ্য ভারাক্রান্ত অনাবশ্যক মনে করছি।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অতি নগণ্য অংশই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। রাজনীতির ছোঁয়াচমুক্ত মোট জনসংখ্যার সিংহভাগই ব্যবসা-বাণিজ্য, খেত-খামার, কল-কারখানায় কায়িক শ্রমের সাহায্যে এবং পেশাজীবীদের বৃহত্তর অংশই পেশাগত বা অপেশাগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জীবিকার্জন করেন। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সিংহভাগ এমনকি কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও দৃশ্যত কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। বাড়িভাড়া, জীবনধারণের অপরিহার্য পণ্যসামগ্রীর আকাশছোঁয়া দামের কারণে রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টভোগী ও ঘুষখোর-লুটেরারা ছাড়া আমজনতা এবং শ্রম ও কর্মজীবীদের বৃহত্তর অংশই পরিবারের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে সর্বদা চোখে সর্ষে ফুল দেখেন। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় এবং নির্ভরশীলদের অপরিহার্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে তাদের প্রায়শ ধার-দেনা করতে হয়। অথচ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের বৃহত্তর অংশেরই হাল ফ্যাশনের বিলাসবহুল জীবনযাপন, পারিবারিক ভরণ-পোষণ এবং শারীরিক চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুর ভ্রমণের ব্যয় নেহাত অলৌকিকভাবেই জোগাড় হয়ে যায়। হায় সেলুকাস! বড় অদ্ভুত এই বাংলাদেশ এবং তার চেয়েও বিস্ময়কর আমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কর্মকাণ্ড বা আচরণ।
রক্তঝরা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যকে কেন্দ্র করে অতি সম্প্রতি নানা কথা পত্র-পত্রিকা ও টক-শোতে প্রতিনিয়ত জোরেশোরে উচ্চারিত/আলোচিত হচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে উচ্চারণ করেছেন, গণ-অভ্যুত্থানে তাদের দলীয় অবদানকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তারা তাওয়া গরম করায় রক্তঝরা জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাহোক, বর্তমানে পাইকারি হারে সাবেক মামলা প্রত্যাহারের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কতটুকু যুক্তিসিদ্ধ, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। আবার অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর এক মাস পর্যন্ত দেশে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি-চাঁদাবাজি, দখলদারি ইত্যাদি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে গত দুই সপ্তাহ থেকে রাস্তাঘাট-হাটবাজারে আবার বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্টদের চাঁদা-টোল-ট্যাক্স ইত্যাদি আদায় পুরোদমে শুরু হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। আর উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের মুখে সংস্কার/কুসংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ না করেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি দিনে দিনে উত্তরোত্তর জোরদার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের নামে সরকারি কোষাগার ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের চিরায়ত ধারা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই এসব দাবি সুকৌশলে উত্থাপন করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো রাজনৈতিক দল বা শীর্ষ নেতাই মনেপ্রাণে কাক্সিক্ষত সংস্কার চান না। স্মর্তব্য, যারা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর দলের প্রধান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে রয়েছেন, তাদের মুখে জাতীয় সংস্কারের দাবি ভূতের মুখে রাম নাম উচ্চারণের মতো বেমানান। কারণ প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয় পর্যায়ে সংস্কার আনার আগেই দলীয় পর্যায়ে সংস্কার সাধন অপরিহার্য।
তাই প্রথমত, বাবা/স্বামীর উত্তরাধিকারী হিসেবে দলীয় প্রধান হওয়ার বাধ্যবাধকতা বা প্রবণতা বর্জন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দলীয় কাউন্সিল নামক ভণ্ডামির পরিবর্তে চার বছর পরপর দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব পদে পরিবর্তন আনতে হবে এবং নতুন নেতৃত্বের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, রাজনীতিতে কালো টাকার মালিক, লুটেরা, লম্পট, দুর্নীতিপরায়ণ ও দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে। চতুর্থত, ন্যায়নিষ্ঠ, নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী গুণী ব্যক্তিবর্গ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভূয়োদর্শী উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাবানদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পঞ্চমত, নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ করতে হবে।
উপসংহারে বলতে হচ্ছে, এবারের গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য ছাত্র-জনতা এবং দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর পরম আত্মত্যাগের সোনালি ফসল। তাই সর্বসাধারণের পছন্দের ভিত্তিতেই জাতীয় মৌলিক সমস্যাবলির স্থায়ী সমাধানপূর্বক বাংলার অধিকারবঞ্চিত জনগণকে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ এবং রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার স্বার্থেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। নতুন সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক এবং নব্য ও উঠতি স্বৈরশাসন-প্রত্যাশীরা ছাড়া দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষই সন্তুষ্ট। ফলে ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোরদের দিবাস্বপ্ন ইতিমধ্যে নস্যাৎ হওয়ার উপক্রম এবং ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এমনতর বাস্তবতায় শ্রদ্ধেয় প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টামণ্ডলী আপনারা সদ্বিবেচনা এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় মৌলিক সমস্যাবলি চিহ্নিতপূর্বক সেগুলোর সুষ্ঠু ও বাস্তবানুগ সমাধান নিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে দেশপ্রেমিক সামরিক-বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত ও ভূয়োদর্শী কর্মকর্তাদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নিজেদের লোকবল বৃদ্ধি করুন। কাক্সিক্ষত সংস্কার এবং জাতীয় মৌলিক সমস্যাদির সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানের পূর্বে চাপের মুখে তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ নিলে পরিণতিতে যাবতীয় প্রাণহানি ও ত্যাগ-তিতিক্ষা পুরোপুরি নিষ্ফল ও ব্যর্থ হবে। অনবদ্য কারণে পলিতকেশ উপদেষ্টামণ্ডলী নিজেদের সততা, সুদীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা, উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীল প্রতিভাগুণে একটি বৈষম্যমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ জাতিকে উপহার দিন। বিশ্ব প্রতিপালক আপনাদের সাফল্যমণ্ডিত করুন। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
১ অক্টোবর ২০২৪

কমেন্ট বক্স