Thikana News
২৩ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

গরিবের মা

গরিবের মা
কোটিপতি ঘরে জন্ম, অভাব কী মুক্তাশা তা জানে না। মনে হয়, মুখে সোনার চামচ নিয়ে তার পৃথিবীতে আসা। তবু বুঝ হওয়ার পর হতে মুক্তাশা কিছুর অভাব যেন উপলব্ধি করতে থাকে, কিন্তু বলার সাহস হয়নি। তা ছাড়া সে কাকে বলবে-বাবার ব্যস্ততা আর মায়ের সমাজসেবা-কারও যেন তা শোনার ফুরসত নেই।
সে একদিন বাবার আলমারি গোছাতে গিয়ে পুরোনো একটি ছবি পেল। তার কেন যেন মনে হলো, এটা সে হতে পারে। তাই অন্য ছবির সঙ্গে মেলানোর পর বুঝে নিল, এটা সে-ই। তবে যার কোলে সে, তাকে চিনতে পারেনি। তাই ভেবে নিয়েছে, বাবা অবসর হলে জেনে নেবে কে এই ভদ্রমহিলা, যাকে বড় হওয়ার পর সে দেখেনি। একদিন সকালে নাশতা করার সময় সে ছবিটা দেখিয়ে বাবার কাছে জানতে চায়, ‘কে এই ভদ্রমহিলা?’ বাবা খুবই রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘তাকে তোমার কিসের প্রয়োজন? এত কিছু জানার দরকার কেন? পড়ালেখায় মনোযোগ দাও, ভালো রেজাল্ট করে মেডিকেলে পড়তে হবে, সেটাই হবে তোমার জীবনের প্রথম ও শেষ ইচ্ছা।’
মুক্তাশা ছবিটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি হে রমণী, যার মুখপানে তাকালে কেবলই বলতে ইচ্ছা হয় মনের গভীরে জমানো মান-অভিমানের কথা, না-পাওয়া মায়ের ভালোবাসার কথা, আর বাবার ব্যস্তার কথা। কেন আমি মায়ের ভালোবাসার মধ্যে কৃত্রিমতা দেখি আর বাবার অবহেলা?’ ছবির সঙ্গে কথাগুলো বলতে বলতে মুক্তাশার অনেক কান্না পেল। ছোটকাল হতে সে যাকে মা বলে জেনেছে, তিনি কখনো কোনো ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেন না, এমনকি লেখাপড়ার ব্যাপারেও তিনি উদাসীন। তার এ ধরনের ব্যবহারে মুক্তাশার মনে হতো, সে নিশ্চিত কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান। তাদের পরিবারে প্রাচুর্য আছে, আসবাবপত্রের চাকচিক্যে চোখ ঝলসে যায় কিন্তু স্নেহ-ভালোবাসা তেমন দেখা যায় না।
একবার তার দূর সম্পর্কের এক ফুপু দু-তিন দিনের জন্য তাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। মুক্তাশা সেই ফুপুর মাঝে মায়ের গন্ধ পেল। তাই সে ফুপুর খুব কাছাকাছি গিয়ে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা ফুপু, তুমি কি আমাকে একটা সত্য কথা বলবে!’ মুক্তাশার মাথায় হাত রেখে চুলে বিলি কাটতে কাটতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী এমন সত্য তুমি আমার থেকে জানতে চাইছ, যে সত্য তোমার বাবা হতে আমাকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে।’ মুক্তাশা বলল, ‘তিনি কি আমার সত্যি মা! তা না হলে আমি কেন তার মধ্যে মায়ের স্নেহ খুঁজে পাই না, মনের না-বলা কথাগুলো বলার সাহস পাই না, তার কাছে ঘেঁষতে গেলে ভয় কাজ করে, কোথাও যেন কোনো রহস্যের গন্ধ অনুমান করি!’ তার ফুপু সত্য লুকিয়ে শুধু এটুকু জানালেন, ‘এটা তোমার ভুল ধারণা। অর্থের মোহ, সমাজের চাপ আর কাজের দায়িত্বের কারণে তোমার বাবা-মা তোমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।’ এত অল্প বয়সে ফুপুর এত কঠিন কথাটার অর্থ না বুঝে সে চুপ করে রইল। যাওয়ার দিন তিনি শুধু বলে গেলেন, ‘সময়ের সাথে সাথে তুমি সব জেনে যাবে।’
অনেক দিন চলে গেল, মুক্তাশা তেমন কিছুই জানতে পারেনি। আর কীভাবেই সে জানবেÑপরীক্ষা, লেখাপড়া নিয়েই তার সারা দিন কেটে যায়। মাঝেমধ্যে সে বাসায়ও ফিরতে পারে না। শত ব্যস্ততার মধ্যেও অসহায়দের ডাকে সাড়া দিতে মুক্তাশার খুবই ভালো লাগত। তাদেরকে নিয়ে ছোটাছুটি করা, যেকোনো কষ্টকর কাজেও তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে তার কোনো কষ্ট হতো না। অনেক বন্ধু তাকে ‘গরিবের মা’ বলে ডাকে। তাতে তার কোনো অভিযোগ নেই। সেও মনে মনে ভাবে, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে একসময় সে ‘গরিবের মা’ই হবে। তার কেন জানি গরিবের প্রতি অন্য রকম অনুভূতি, যা সে কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না।
বাবা ও মায়ের মতো মুক্তাশাও জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। বিয়ের কথা হলেই সে বলে, ‘বাবা, আমাকে একটু সময় দাও। আমিও তোমাদের মতো নিজেকে সমাজসেবায় নিয়োজিত করতে চাই।’ এত যশ ও সুনামের পেছনে ছুটতে ছুটতে তার বয়স প্রায় তিরিশ। একদিন বাবা তাকে ডেকে বললেন, ‘মা, অনেক তো হলো, এবার তোমার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।’ সে হাসতে হাসতে বাবাকে বলেছিল, সে যদি বিয়ে করে, তাহলে ‘গরিবের মা’ কে হবে? বাবা বলেছিলেন, ‘মা, সবকিছু করতে হবে আর নিজেকে নিয়েও ভাবতে হবে।’ উত্তরে মুক্তাশা বলেছিল, ‘তুমি যা ভালো মনে করো তা-ই করো, আমি আর আপত্তি করব না।’
এরই মধ্যে ডাক্তারি শেষ করে মুক্তাশা ছোট্ট একটি চেম্বারের খোঁজ পেয়ে সেখানে বসার সিদ্ধান্ত নিল। সমাজে যেসব মা অপমানিত, যেসব মা বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত, যেসব মা ডাক্তারের ভিজিট দিতে অক্ষম, কেবল তারাই হবে তার এই চেম্বারের রোগী। তাদের যাবতীয় ওষুধের খরচও সে বহন করবে। এদিকে মুক্তাশার বাবা ভালো বর, ভালো ঘর দেখে তার বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি করে ফেললেন। তিনি জানেন, তার মেয়ে এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি করবে না।
আজ মুক্তাশার বিয়ে। বাসায় অনেক মেহমান। অনেককে সে চিনতে পেরেছে, কাউকে কাউকে চেনে না। বিয়ের সাজে সে বসা। এ সময় এক বিধবা মহিলা তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আহারে, আজ যদি তোমার মা এই খবরটা জানতেন...’ অসম্পূর্ণ এই কথাটি বলেই তিনি কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে সরে পড়লেন। মুক্তাশা কথাটি স্পষ্ট করে শুনতেও পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও মুক্তাশা সেই মহিলার খোঁজ পেল না।
বড়লোকের মেয়ের বিয়ে। কোথাও যেন কোনো কিছুর কমতি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি ছিল তার ফুপুর। গান-নাচ ও হাসিতে ভরপুর অনুষ্ঠানটি ছিল চমকপ্রদ। সময় গড়িয়ে এল বাসর রাত। বাসরঘরে কাঁচা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। নীলাভ রঙের বাতিতে মুক্তাশা প্রতীক্ষা করছে তার প্রিয়তমের জন্য। ঘড়িতে প্রায় যখন একটা বাজে, তখনই নীরবে রুমের প্রবেশদ্বারে তারই জীবনসঙ্গী, ‘আমি কি আসতে পারি?’ কী সুন্দর ব্যবহার, অনুমতি নিয়ে বাসরঘরে প্রবেশ! ছোট্ট উত্তর, ‘জি।’ নীলাভ আলো, কাঁচা ফুলের গন্ধ, তার সঙ্গে যুক্ত হলো পারফিউমের গন্ধ। ‘কেমন আছেন আপনি?’ উত্তরের প্রত্যাশায় বর। লজ্জায় লাল মুক্তাশা ‘ভালো’ বলেই চুপ করে রইল। সে মনে মনে ভাবল, কী চমৎকার তার কথা বলার ধরন, প্রথমেই আপনি বলে সম্বোধন!
ঠিক সেই সময়ে জরুরি কল এল মুক্তাশার সেলফোনে। ‘আমি কি কলটা ধরতে পারি’, স্বামীর অনুমতি নিয়েই কলটা ধরল মুক্তাশা। অপর পাশ থেকে তারই জুনিয়র ডা. তাকে জানাল, এক বৃদ্ধা মহিলা আজ তিন ধরে এখান হতে যাচ্ছেন না। শুধু তা-ই নয়, তিনি কোনো রকম সহযোগিতা করার সুযোগও দিচ্ছেন না, তার শুধু একটাই কথা-তিনি এখনই আপনাকে দেখতে চান। যদি তিনি মারা যান, তবে এর জন্য তিনি তাদের দায়ী করে রেখে যাবেন। এ কারণেই কলটা করা। ‘আমি আপনার কাছে ভীষণ লজ্জিত, সরি ম্যাম’ বলেই জুনিয়র ডা. চুপ করে রইল। মুক্তাশা কী করবে, তা ভাবছে। এমন দিনে কীভাবে বিষয়টা বলা যাবে, এ নিয়ে সে যখন চিন্তিত, তখনই শাহেদ তাকে প্রশ্ন করল, ‘কোনো সমস্যা?’ ‘জি, সমস্যাই বটে।’ শাহেদ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘এই রাত শুধু আমার আর তোমার। সাক্ষী থাকবে কেবল আকাশের তারা ও চাঁদ। সুতরাং সমস্যার কথাটা না শুনলেই নয়?’ উত্তরে মুক্তাশা জানাল, ‘আমার জীবনটা এমনইÑএই বাস্তবিক জীবনকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমার বাসররাতটা এতটা পরে এল!’ ঠিক আছে বলেই শাহেদ ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলল। দুজনই গাড়িতে উঠে বসল। নির্বাক, নিশ্চুপ দুজনই। দুজনের কাজই হচ্ছে মানবতার সেবা। কী বলবে আর কী বলবে না, এ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই চেম্বারে এসে উপস্থিত দুজনই। মুক্তাশাকে দেখেই বৃদ্ধা মহিলাটি তাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! কিন্তু মুক্তাশা চিন্তা করতে পারছে না এমন রোগী এর আগে সে দেখেছে কি না? বৃদ্ধা মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি খবরটা পেয়ে অনেক দূর হতে ছুটে এসেছি।’ পুরোনো জীর্ণশীর্ণ একটি ব্যাগ থেকে ছবি বের করে মুক্তাশার চোখের সামনে ধরে বললেন, ‘তুমি আমার নাড়িছেঁড়া ধন, তুমি আমার সেই হারানো সন্তান, যাকে তোমার বাবা আমার থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে কিন্তু আমি তো কোনো অপরাধ করিনি, যে অপরাধ তোমার বাবা করেছে, তাকে আমি কখনো ক্ষমা করব না। সে আমাকে বহুদূরে নিয়ে ফেলে রেখে গেছে আর তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। আমার অপরাধ, আমি গরিব ঘরের সন্তান, আমাকে কেবল ভোগ করা যায় কিন্তু সমাজে বরণ করে নেওয়া যায় না। সুতরাং তুইও তোর বরকে বলে দে, তুইও একটি গরিব মায়ের সন্তান, যার জন্ম গরিবের গর্ভে। সে কি তোকে বরণ করে নেবে নাকি বিশাল জঙ্গলে রেখে আসবে গরিব ঘরের সন্তান বলে?’ কান্নার কারণে মুক্তাশা মায়ের কোনো কথার উত্তর দিতে পারছে না। সে কাঁদতে কাঁদতে তার নতুন বরণ করা স্বামীর কাছে একটি অনুরোধ করে বসল, ‘আপনি যদি আমার এই গরিব মাকে সম্মান দিয়ে আপনার সংসারে স্থান দিতে পারেন, তাহলেই আমি আপনার সংসারের ঘরনি হতে রাজি। তা না হলে আমি আমার মাকে নিয়ে সেই অজপাড়াগাঁয়ে চলে যাব, যেখানে আমার জন্ম আর রয়েছে আমার মায়ের তিক্ততার অতীত স্মৃতি।’
এসব কথা বলার সময় মুক্তাশা ভুলে গিয়েছিল আজ তার রঙিন বাসর রাত, বরং তার কাছে মনে হয়েছে বাসর রাতের চেয়েও বেশি আনন্দের, বেশি আবেগের তার হারানো মাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। যে আনন্দের সঙ্গে কোনো আনন্দের তুলনা করা যায় না।

কমেন্ট বক্স