যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে যেন বের হয়ে আসতে পারছে না বিশ্ব। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকেই মারাত্মক এক অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত তথা ফিলিস্তিনের অধিকৃত গাজায় ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সংঘাতকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতেই যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল ইরান। দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেট ভবনে হামলার জের ধরে গত ১৩ এপ্রিল শনিবার দিবাগত রাতে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলে এটাই ইরানের প্রথম সরাসরি এ ধরনের হামলা। গাজা যুদ্ধের মধ্যেই এ ধরনের সামরিক সংঘাতের আবহে ঘোর সংকটে পড়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্য। বলা বাহুল্য, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এর প্রভাব থেকে বিশ্বও মুক্ত থাকবে না।
ইরানের নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর বিশ্বের নজর এখন ইসরায়েলের দিকে। তারা প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিলেও কীভাবে হামলার জবাব দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের হামলার আশঙ্কায় নিজেদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো বন্ধ রেখেছে ইরান। আবার তেহরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে।
অন্যদিকে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের কেন্দ্রীয় যে ইস্যু- সেই গাজা উপত্যকায় ১৪ এপ্রিল রোববার থেকে অভিযান সীমিত করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা থেকে নিজেদের সেনাদের অধিকাংশই প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ইসরায়েলি সেনাদের মাত্র একটি ডিভিশন বর্তমানে গাজায় অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে দক্ষিণ ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে নিয়মিত রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে হিজবুল্লাহ। গত ছয় মাসে গোষ্ঠীটি প্রায় ৩ হাজার ১০০ রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। তবে ১৫ এপ্রিল সোমবার থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে কোনো বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেনি হিজবুল্লাহ। কিন্তু হামলার পর এই যে স্থিতাবস্থা, তাতে স্বস্তির তেমন জোরালো কোনো কারণ দেখছেন না মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। কারণ, গাজা থেকে অধিকাংশ সেনাকে প্রত্যাহার করে নিলেও সেখানে অভিযান বন্ধের কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত দেয়নি ইসরায়েল বা আইডিএফ। অন্যদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি-সংক্রান্ত যে প্রস্তাব এই যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর দিয়েছে, তাতে এখনো সম্মতি দেয়নি হামাস।
বিশ্লেষকদের মতে, তেহরান-হামাস-হুতিদের এই নীরবতা আসলে শান্তির আগমনী বার্তা নয়, বরং ঝড়ের আগের স্থিতাবস্থা। বড় ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতিতে যেন খুব শান্ত ভাব দেখা দেয়-এখনকার অবস্থাও তেমনই। তারা বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর উচিত হবে এই শান্ত অবস্থায় আশাবাদী না হয়ে পরবর্তী বড় হামলা ঠেকানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল এখনো বাংলাদেশসহ বিশ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন এক পটভূমিকায় আবারও মধ্যপ্রাচ্যে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়লে বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও মূল্য দিতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ভুগছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছেন।
ইরানের হামলা ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা শনিবার দিবাগত রাতে। ইসরায়েলের আকাশে বেজে ওঠে সতর্কতার সাইরেন। নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানায় ইসরায়েল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে বিস্ফোরণ হতে থাকে। আকাশ প্রতিরক্ষা এরই মধ্যে সক্রিয় করা হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, অন্তত ১৭০টি ড্রোন, ৩০টি ক্রুজ মিসাইল ও ১২০টি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান। স্থানীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, আল আকসা মসজিদের ওপর দিয়ে ইসরায়েলের দখল করা অংশে বৃষ্টির মতো ড্রোন পড়ছে। তেল-আবিব অবশ্য এসব ড্রোনের বেশির ভাগই আকাশে বিস্ফারিত করেছে। বিবিসি জানিয়েছে, ইরানের পাশাপাশি এসব হামলা ইরাক, ইয়েমেন ও সিরিয়া থেকে করা হয়েছে। লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারাও এ সময় দুই দফা রকেট হামলা করেছে ইসরায়েলে। আল-জাজিরা জানিয়েছে, হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষায় সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জর্ডান। এ কথার মানে হলো-এই হামলায় অন্তত নয়টি দেশ জড়িয়ে পড়েছে।
হামলায় ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা কেন্দ্র ও একটি বিমানঘাঁটি ধ্বংসের দাবি করেছে ইরান। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এ দাবি করেছেন। তবে ইসরায়েল বলছে, ৯৯ শতাংশ হামলাই তারা প্রতিহত করেছে, আর মাত্র একজন আহত হয়েছে।
ইসরায়েলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য খাদের কিনারে। এ অঞ্চলের মানুষ একটি পূর্ণমাত্রার ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এখনই সময় তাদের খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে আনার। আর এ দায়িত্ব যৌথভাবে সবার।
এ ঘটনার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। যদিও সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে তোড়জোড় চলছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ইরানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের যুদ্ধবিষয়ক বিশেষ মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। বৈঠকের পর তারা জানিয়েছে, ইরানে পাল্টা হামলা চালাবে। ১৫ এপ্রিল সোমবার দ্বিতীয় দফায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সূত্র বলছে, ইরানে শিগগিরই পাল্টা হামলা চালানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা। তবে কখন ও কীভাবে হামলা হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান হেরজি হালেভিও শুধু এটুকু বলেছেন, ইরানের বিপুল ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেওয়া হবে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
তবে ইসরায়েল কোনো প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা করলে ‘আরও অনেক বড় পরিসরে’ হামলার মধ্য দিয়ে এর জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। ১৪ এপ্রিল এ কথা বলে ইসরায়েল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছে তেহরান। ইরান বলেছে, তার প্রতিশোধমূলক হামলা আপাতত এখানেই শেষ। তাদের হামলার উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে।
মার্কিন প্রশাসন যদিও বলছে, তারা ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানে হামলা চালাবে না, তার পরও আশঙ্কা কাটছে না। কারণ ইসরায়েলকে পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা দিচ্ছে দেশটি। ইতিমধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ কংগ্রেসে পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো পরাশক্তিগুলো ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশ তিনটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে তেহরান।
ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংসতা চালানোর জেরে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েছিল ইসরায়েল। দেশটির সমালোচনা করছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও। তবে ইরানের হামলার পর অনেক মিত্রকে আবার পাশে পেয়েছে ইসরায়েল। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তেহরানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে তারা। এ তৎপরতার অংশ হিসেবে ৩২টি দেশকে চিঠি দিয়েছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎস। তাতে তিনি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া অনুরোধ করা হয়েছে আইআরজিসিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তকমা দেওয়া ছাড়াও নানা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিতে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইসরায়েলের অন্য মিত্র দেশগুলো ইরানকে বিশ্বের জন্য ‘সত্যিকারের নিরাপত্তা-হুমকি’ বলে অভিহিত করে বলেছে, তেহরানকে ঠেকাতে তাদের যা যা করণীয়, সবই তারা করবে। কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে ইরানি রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এরই মধ্যে প্রকাশ্যে জানিয়েছে, তারা বাড়তি কোনো সামরিক সংঘাত চায় না। হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করলেও নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছেন, ইরানে যেন ইসরায়েল হামলা না চালায়। তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ‘সতর্কতার সঙ্গে ভাবার’ পরামর্শ দিয়েছেন নেতানিয়াহুকে। ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার সম্ভাব্য পরিণতি কী হবেÑএ নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ তুলে ধরছে অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। যেমন বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার বলেছেন, সংঘাতের পরিণতি কী হতে পারে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েল এখন কী করবে, এর ওপর। তেল-আবিব মিত্রদের কথামতো ‘কৌশলগত ধৈর্য প্রদর্শন’ করতে পারে। আবার ইরানের মতোই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা হামলা করতে পারে, তবে তা সতর্কভাবে শুধু সামরিক স্থাপনায়। এমনকি ইরান যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী পাল্টা হামলাও তারা চালাতে পারে। বিশেষ করে, তৃতীয় বিকল্পটি বেছে নিলে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়তে পারে। এর প্রভাব পড়বে প্রথমে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে, পরে পৃথিবীজুড়ে।